শুভ নেই, আয়ও নেই, অথৈ সাগরে মা রেণু

প্রকাশিত: ১:২৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৬, ২০২৪

ঢাকা প্রতিনিধি:

রেণু বেগম (৪২) যেটিকে দোকান বলছেন, সেটিকে ঠিক দোকান বলা যায় না। রাজধানীর ধানমন্ডি ৩ নম্বর সড়কের ফুটপাতে রিকশা মেরামতের টুকিটাকি কিছু সরঞ্জাম রাখা। সকাল ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত সেখানে চলে মেরামতের টুকটাক কাজ। এতে সারাদিন খেটেও আয় হয় যৎসামান্য।
অর্ঘ্য ভাস্কর্যের পাশের সেই ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রেণু ইশারায় আলিয়ঁস ফ্রঁসেজের পাশের গলিমুখ দেখিয়ে বলছিলেন, সবাই মিছিল নিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ির দিকে গিয়েছিল। গুলির কারণে সেখান থেকে ফিরে ৩ নম্বর রোডের মাথায় ছাত্ররা অবস্থান নেয়। তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসার দিক থেকে হেলিকপ্টারটি আসে। শুরুতে সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়লেও পরে ওপর থেকে গুলি করা হয়। গুলি লাগে শুভর মাথায়। ঢাকা মেডিকেলে পরদিন ভোরে মারা যায় ছেলে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিতে কর্মক্ষম ছেলেকে হারানো রেণু বলেন, ‘টানাপোড়েনের সংসার; ২ বছর ৯ মাস আগে ১০ হাজার টাকা সুদের ওপর নিয়েছিলাম। মাসে এক হাজার টাকা করে দিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু মূল টাকা শোধ করতে পারিনি আজও। শুভ সাইকেল-রিকশার সব কাজ পারত। দিনে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা কামাইত। আমি কিছু কিছু কাজ জানি, সব কাজ পারি না। তাতে দিনে ৪০০ টাকার বেশি হয় না। বড় ছেলে সোহাগ (২৪) এখন আমার সঙ্গে থাকলেও সব কাজ সেও পারে না। প্রায় ১৫ বছরের মতো দোকানটা চালাই। মাঝে বছর দুয়েক বন্ধ রাখছি। শুভ অটোরিকশা চালিয়ে তখন সংসারের খরচ দিত।’
তিনি আরও বলেন, লাশের ময়নাতদন্তের কাগজ নিতে নিউমার্কেট থানা পুলিশকে ৫ হাজার টাকা আর আজিমপুরে দাফনে ৮ হাজার টাকা দিতে হয়। লোকজনের কাছে চেয়ে এবং স্বজনের কাছ থেকে ওই টাকা জোগাড় করেন। এখনও তা শোধ করতে পারেননি।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের বেশ আগে শুভর মৃত্যু হওয়ায় নিপীড়নও সইতে হয়েছে পরিবারটিকে। শুভ আন্দোলনে নিহত হয়েছে– এ খবর জানার পর মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজারে সাবেক এমপি সাদেক খানের মালিকানাধীন ভাড়া বাড়ি থেকে শুভর পরিবারকে বের করে দেওয়া হয়। গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে রায়েরবাজার বৈশাখী খেলার মাঠের পাশে জাগো স্কুলের গলিতে একটি বাসায় উঠেছে তারা। এক কক্ষের সেই বাসার ভাড়াও সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।
রেণু জানান, তাঁর প্রথম স্বামী আবুল হোসেনের সংসারে চার সন্তান– সোহাগ, শুভ, জান্নাতুল ফেরদৌস ও খাদিজা আক্তার মিম। আবুল হোসেন সংসার ছেড়ে গেলে বর্তমান স্বামী মো. শামীমের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। এ সংসারেও রয়েছে তিন সন্তান– ফারজানা আক্তার সুমি, শামীমা আক্তার রুমি ও আরাফাত ইসলাম সোহান। শুভ দোকানে একটি ফ্লাস্কে চা রাখত। শামীম এখন সেই ফ্লাস্ক নিয়ে ঘুরে ঘুরে চা বিক্রি করেন। মেয়ে জান্নাতুল, মিম ও সুমি ল্যাবএইডের সামনে বেলুন বিক্রি করত। জান্নাতের বিয়ের বয়স হওয়ায় তাকে আর ওই কাজে পাঠাতে পারেন না। তবে কোনোভাবেই আটজনের সংসার চালাতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘চা-রুটি খাই। মাঝেমধ্যে ভাত খাই। আমার ডায়াবেটিস আছে। পিত্তথলির অপারেশন করেছিলাম বছর দেড়েক আগে। আমার তো ওষুধ খাওয়ার দরকার হয়, এজন্য দুপুরে ভাত খাইতে পারলে ভালো হয়। কিন্তু প্রতিদিন তো তা সম্ভব হয় না।’
ছাত্র আন্দোলনে ঢাকায় ১৯ জুলাই ছিল উত্তপ্ত একটি দিন। সরকারি বাহিনী আন্দোলনকারীদের ওপর ব্যাপক চড়াও হয়। এদিন ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোডে শুভ গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী জাওয়াদ চৌধুরী। একই সড়কের বাসিন্দা জাওয়াদ আক্ষেপ করে বলেন, সরকার অনেক কাজ করছে; কিন্তু একজন শহীদের মা কেন এতটা মানবেতর জীবনযাপন করবেন? ঘটনার দুই মাস পার হয়েছে। কেন আজও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হলো না, তা বুঝতে পারছি না। তবে আমি আশাবাদী, ভালো কিছু হবে; কিন্তু এখন পর্যন্ত খোঁজখবর না নেওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক।