জেলা প্রতিনিধি,রাজশাহীঃ
বর্ষা ও শরত্কাল বাদে প্রায় সারা বছরই পানিশূন্য থাকে এক সময়ের প্রমত্তা পদ্মা। শুষ্ক মৌসুমে মৃতপ্রায় পদ্মা নদীর দিকে তাকালে একেবারে তলদেশে পানি দেখা যায় যত্সামান্য। চারদিকে দেখা যায় শুধু ধু-ধু বালু চর। বিস্তীর্ণ পদ্মার চরের দুই তীর ঘেঁষে মানুষ তৈরি করে ফসলের মাঠ। শুকিয়ে যায় সব শাখা নদী, খাল।
এদিকে পদ্মায় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক না থাকায় চাপ বেড়েছে তীরবর্তী এলাকার ভূগর্ভের ওপর। কয়েক দশক ধরে অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলের ৪০ শতাংশেরও বেশি ইউনিয়নে পানিশূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। এর প্রভাবে মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে খাবার ও সেচের পানির।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিগত ৪০ বছরে পদ্মার আয়তন অর্ধেকে নেমেছে। পদ্মায় পানির গভীরতার পাশাপাশি কমেছে প্রবাহ। আবাসস্থল হারিয়ে বিলুপ্তির পথে বিভিন্ন দেশীয় প্রজাতির মাছ ও জলজ প্রাণী। হুমকিতে পড়েছে পদ্মার পুরো জীববৈচিত্র্য। ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে একতরফা পদ্মার পানি প্রত্যাহারের ফলে এই সংকট সৃষ্টি হয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
রিভার অ্যান্ড ডেলটা রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশের পশ্চিম উপকূলের নদনদীর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত পদ্মা। পদ্মায় পানির প্রবাহ কমে যাওয়ায় গড়াই, কপোতাক্ষ নদীতে চর জেগেছে। দেশের ৫৭ আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রায় সবই নাব্যসংকটে পড়েছে। আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে পদ্মা ও তিস্তা অববাহিকা সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে। রাজশাহী থেকে জিকে প্রকল্প পর্যন্ত মরুকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়েছে। সুন্দরবন থেকে বরিশালসহ পুরো খুলনা অঞ্চল বড় স্যালাইনিটির মধ্যে পড়েছে। এর প্রভাবে সুন্দরবনে বাড়ছে লবণাক্ততা। পদ্মা ও তিস্তা অববাহিকার ৪ কোটির বেশি মানুষ সুপেয় ও নিরাপদ খাবার পানি পাচ্ছে না।
এদিকে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী ‘বায়োডাইভারসিটি অ্যান্ড কনজারভেশন’ ২০২৩ সালের জানুয়ারি সংখ্যার গবেষণার তথ্যে বলা হয়েছে, ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ। মিঠা পানির সরবরাহ কমেছে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া পদ্মা অববাহিকায় বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত কমেছে ১৯ দশমিক ২ শতাংশ। ১৯৮১ সালে যেখানে তাপমাত্রা ছিল ২৫ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১৯ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৬ দশমিক ২ ডিগ্রিতে। মূলত পদ্মার প্রকৃত অবস্থা বুঝতেই গবেষণার জন্য শুকনো মৌসুমকে বেছে নেওয়া হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট গবেষকরা। এই গবেষক দলে থাকা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামস মুহাম্মদ গালিব বলেন, ‘আমরা ১৯৮২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত পদ্মার হাইড্রোলজিক্যাল, জলবায়ু ও নৃতাত্ত্বিক পরিবর্তনের সঙ্গে মত্স্য প্রজাতির সম্পর্কের প্রক্রিয়া অনুসন্ধান করছিলাম। এটা করতে গিয়ে দেখা গেছে, পদ্মার আয়তন বর্তমানে অর্ধেক কমে গেছে। এর প্রভাব পদ্মার পুরো জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব পড়েছে।’ তিনি আরো বলেন, রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে চারঘাটের সরদহ পর্যন্ত পদ্মার ৭০ কিলোমিটার অংশে গবেষণা পরিচালিত হয়। এই এলাকার ৯টি পয়েন্টে মত্স্য প্রজাতির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। পদ্মাপাড়ের ২৭টি জেলেপল্লি থেকে নেওয়া হয় তথ্য। স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবি বিশ্লেষণের মাধ্যমে পদ্মার বর্তমান চিত্র তুলে আনার চেষ্টা করেন গবেষকরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা নদীর চেহারা পালটাতে শুরু করে ১৯৭৫ সালের পর।
নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (হাইড্রলিক রিসার্চ) পিন্টু কানুনগো বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমের ছয় মাস পদ্মা প্রায় পানিশূন্য হয়ে পড়ে। এটি সর্বত্র দৃশ্যমান। পদ্মা-গঙ্গা অববাহিকায় প্রবাহ আগের তুলনায় কমেছে।’ পদ্মায় পানি প্রবাহ পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে মন্তব্য করে নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘এই সংকটের শেকড় অনেক গভীরে। পদ্মার বর্তমান রুগ্নদশার কারণ সবাই জানেন-বোঝেন। সংকট মোকাবিলায় অববাহিকাভিত্তিক বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালকে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।’