নিজস্ব প্রতিবেদক:
জনআকাঙ্ক্ষা থাকলেও শেষ পর্যন্ত সমঝোতার কোনো পথ খোলেনি। দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপের পরও সম্ভব হয়নি সংলাপ। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের রাজপথে মারমুখী অবস্থানের মধ্যেই আজ দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) একাধিক সূত্র।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের আজ সন্ধ্যা ৭টায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেওয়ার কথা রয়েছে। এ ভাষণেই তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে। এর আগে তপশিল চূড়ান্ত করতে বিকেল ৫টায় কমিশন সভায় বসবে। বৈঠকের পরই সিইসির ভাষণ বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হবে। নাটকীয় কিছু না ঘটলে আজই তপশিল ঘোষণা অনেকটা নিশ্চিত। এদিকে ইসি কার্যালয়ের সচিব জাহাংগীর আলম বলেছেন, আজ সকাল ১০টায় সংবাদ সম্মেলনে তপশিলের বিষয়ে কমিশনের অবস্থান খোলাসা করবেন।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সে বলেছেন, দু-একদিনের মধ্যেই নির্বাচন কমিশন তপশিল ঘোষণা করবে। কিছুদিন ধরে ইসির কর্তারা সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ না বললেও নভেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল এবং জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ভোট গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে আসছিলেন।
ইসির পক্ষ থেকে আগেই বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়ার দায়িত্ব ও সক্ষমতা ইসির নেই। তবে ইসি সূত্র জানিয়েছে, তপশিল ঘোষণা হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ ও সমঝোতার পরিস্থিতি তৈরি হলে পুনঃতপশিলের পরিকল্পনা তাদের রয়েছে। এর আগে ২০১৮ সালের নির্বাচনেও তৎকালীন কে এম নূরুল হুদা কমিশন প্রথমে ২৩ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করে তপশিল ঘোষণা করে। পরে রাজনৈতিক সমঝোতায় এক সপ্তাহ পিছিয়ে ৩০ ডিসেম্বর ভোট গ্রহণের দিন নির্ধারণ করা হয়েছিল।
সংশ্লিষ্টরা অবশ্য বলছেন, চলমান অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে সমঝোতা ছাড়া তপশিল ঘোষণা পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তুলতে পারে। রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামী বর্তমান সরকারের পদত্যাগের দাবিতে দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে অবরোধ করছে। তপশিলের পর অবরোধের সঙ্গে আরও নতুন কর্মসূচি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিরোধী জোটের নেতারা। নতুন এ কর্মসূচি আজ ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছে বিএনপির দলীয় সূত্র। এর বাইরে আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সমঝোতা ছাড়াই তপশিল ঘোষণা করা হলে ইসি অভিমুখে গণমিছিলের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে চরমোনাই পীরের দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। এদিকে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের জোট শরিক সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি (জাপা) নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি এখনও চূড়ান্ত করতে পারেনি।
নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে তিন দশক ধরেই মতবিরোধ চলছে। এরই মধ্যে নবম সংসদে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দাবি করছে, আদালতে বাতিল হওয়ার ফলে এ ব্যবস্থা আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। অন্যদিকে সরকারবিরোধীরা বলছে, নির্বাচনকালীন সরকার হতে হবে ‘নিরপেক্ষ’। অন্যথায় তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না।
একই দাবিতে ২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করলেও ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল বিএনপি। ওই নির্বাচনে ব্যাপক অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ তুলে এখন তারা সরকারের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলনে রয়েছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে ভোটের আগে দু’পক্ষের মধ্যে একাধিক সংলাপ হলেও এবার পরিস্থিতি পুরোপুরি ভিন্ন। এ নির্বাচন ঘিরে বন্ধু রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত ইতোমধ্যে তাদের ভিন্ন অবস্থান তুলে ধরেছে।
সর্বশেষ সোমবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিকে চিঠি দিয়েছেন। তবে গতকাল ইসি সচিব জাহাংগীর আলম তাঁর কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ডোনাল্ড লুর চিঠির কোনো প্রভাব তপশিলের ওপর পড়বে না।
এরই মধ্যে গতকাল রাতে অকস্মাৎ রাষ্ট্রপতি মোঃ সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবনে ডেকে পাঠিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে। তপশিল ঘোষণা এবং যুক্তরাষ্ট্রের চিঠি নিয়ে রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে রাত ৮টায় তিনি বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত তিনি বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলেন।
তবে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর চিঠির বিষয়ে গতকাল ঢাকায় ১৪ দলের এক সমাবেশে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, শর্তহীন সংলাপ করতে হলে বিএনপিকে সরকার পতনের এক দফা প্রত্যাহার করতে হবে। পাশাপাশি সহিংসতা ছাড়তে হবে। তিনি বলেন, ২৯ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপি-জামায়াত রাজপথে নেই। তাদের ‘প্রভু’ ধমক দিয়েছে, সুষ্ঠু নির্বাচন না হলে ভিসা নীতি প্রয়োগ হবে; স্যাংশন (নিষেধাজ্ঞা) দেওয়া হবে। সোমবার থেকে চিত্র বদলেছে। এখন তারা শর্তহীন সংলাপের কথা বলে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছে।
এদিকে, চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা জাতীয় অর্থনীতিকে শঙ্কার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর আয়োজনে গতকাল ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক মতবিনিময় সভায় এ শঙ্কার কথা উঠে আসে। জাতীয় অর্থনীতির স্বার্থে সব ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড পরিহারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
এদিকে, আজ বুধবার তপশিল ঘোষণা হলে আনন্দ মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আওয়ামী লীগ। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমন্ডির কার্যালয়ে এক বৈঠকে কেন্দ্রীয় নেতারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
অন্যদিকে তপশিল ঘোষণা হলে চলমান আন্দোলনের গতি বাড়াতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। চলমান কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বুধবার থেকে আবারও সারাদেশে ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। তপশিল ঘোষণা হয়ে গেলে অবরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি হরতাল, ঢাকা ঘেরাও বা ইসি অভিমুখে পদযাত্রার কর্মসূচি আসতে পারে।
বিএনপির সমমনা দল হিসেবে আন্দোলনে থাকা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি সভাপতি আ স ম আবদুর রব গতকাল এক বিবৃতিতে বর্তমান পরিস্থিতিতে তপশিল ঘোষণা থেকে ইসিকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, নীল নকশার অংশ হিসেবে একতরফা নির্বাচনের ঘোষণা হবে সংঘাত এবং রক্তপাতকে উস্কানি দেওয়া।
ইসির সর্বাত্মক প্রস্তুতি
সংবিধান অনুযায়ী ১ নভেম্বর থেকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ৯০ দিনের ক্ষণ গণনা শুরু করেছে ইসি। এরই অংশ হিসেবে যে কোনো মূল্যে আগামী ২৯ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন আয়োজন ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবছে না ইসি।
তপশিলের সার্বিক প্রস্তুতি নিয়ে গতকাল দিনভর ব্যতিব্যস্ত ছিল ইসি সচিবালয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসি সচিবসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা অফিস করেছেন। তারা সর্বশেষ প্রস্তুতি নিয়ে বৈঠকও করেছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল ইসি সচিব জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে রেওয়াজ অনুযায়ী সিইসি জাতির উদ্দেশে ভাষণের মাধ্যমে তপশিল ঘোষণা করেন। এবারও তা অনুসরণ করা হবে।
তপশিল ঘোষণার প্রাক্কালে সংলাপ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চিঠির বিষয়ে তপশিলে প্রভাব পড়বে কিনা– জানতে চাইলে ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম বলেন, অবশ্যই না। কোনো প্রভাব পড়বে না। তিনি বলেন, প্রথমে কথা হচ্ছে, সংলাপের চিঠি কিনা– এ বিষয়ে কমিশন অবহিত নয়। কমিশনের কাছে কিছুই আসেনি। কমিশন তার নিজস্ব গতিতে সাংবিধানিক দায়বদ্ধতার আলোকে যেভাবে রোডম্যাপ হয়েছিল, সেভাবে অগ্রসর হচ্ছে।
জাতীয় নির্বাচনের ভোটার তালিকা ইতোমধ্যে চূড়ান্ত করেছে ইসি। দেশে মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৯১ হাজার ৬৩৩ জন। পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭ লাখ ৭১ হাজার ৫৭৯ জন এবং নারী ভোটার ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৯ হাজার ২০২ জন। আর তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার ৮৫২ জন। সারাদেশে ভোটকেন্দ্রের খসড়াও প্রস্তুত করা আছে। বিধান অনুযায়ী তপশিলের পর ভোটকেন্দ্র চূড়ান্ত করা হবে। স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স, মার্কিং সিলসহ প্রয়োজনীয় সব ধরনের সিল ছোট-বড় চটের বস্তা ও নির্বাচনের অন্যান্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের বেশির ভাগ ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।
অনলাইনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সুবিধা-সংবলিত এবং প্রার্থী, ভোটারদের জন্য নানা ধরনের সুবিধাযুক্ত দুটি অ্যাপস উদ্বোধন করা হয়েছে। তপশিল ঘোষণার পর কখন কোন কাজটি করা হবে, তা-ও চূড়ান্ত করা আছে। ভোটার তালিকার সিডি, মনোনয়ন ফরম ও নির্বাচন পরিচালনা ম্যানুয়াল (নির্দেশিকা) ছাপানো সম্পন্ন হয়েছে।
প্রশিক্ষক হিসেবে যারা প্রশিক্ষণ দেবেন, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপার (এসপি) ও জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তপশিল ঘোষণার পর নির্বাচনী কর্মকর্তা (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা) নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। নিয়ম অনুযায়ী প্রতীক বরাদ্দের পর শুরু হবে ব্যালট পেপার ছাপানোর কাজ।
এদিকে, তপশিল ঘোষণাকে কেন্দ্র করে আগারগাঁওয়ে কমিশন ভবন ও এর আশপাশ এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। কমিশন ভবনে এনআইডি সংশোধনের জন্য ব্যক্তিগত শুনানি কাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বন্ধ করা হয়েছে।