সন্তানের খাবার খাওয়ায় শিশু গৃহকর্মীকে হত্যা করেন গৃহকর্ত্রী সাথী

প্রকাশিত: ৬:১১ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ৩, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
রাজধানীর কলাবাগানের সেন্ট্রাল রোডের একটি অভিজাত ফ্ল্যাটে থাকেন গৃহকর্ত্রী সাথী আক্তার পারভীন ডলি। গত তিন বছর আগে নিজ গ্রামের বাড়ি থেকে হেনা নামে এক শিশুকে গৃহকর্মী হিসেবে তার বাসায় আনা হয়। গৃহকর্ত্রী সাথীর সন্তানের দেখাশোনো করতো শিশু গৃহকর্মী হেনা। মাঝে মাঝে সাথীর সন্তানের খাবার খেয়ে ফেলতো সে। এ কারণে ক্ষুব্ধ হয়ে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে শিশু গৃহকর্মী হেনাকে হত্যা করেন গৃহকর্ত্রী সাথী। এমন অভিযোগে গত শুক্রবার (৩১ আগস্ট) যশোর থেকে ঘাতক গৃহকর্ত্রী ডলিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। আজ রোববার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিএমপির রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন।
তিনি বলেন, গত ২৬ আগস্ট সকালে কলাবাগানে সাথীর বাসার দরজা ভেঙে বিছানায় একটি লাশ পাওয়া যায়। পরে জানা যায়, লাশটি গৃহকর্ত্রী সাথীর গৃহকর্মী হেনার। শিশুটির শরীরে নতুন-পুরোনো অনেক আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়। বাসার সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, পা দিয়ে গলা চেপে হেনাকে নির্যাতন করা হতো।

ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, ২০২০ সাল থেকে হেনা ওই বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে আসছিল। গৃহকর্ত্রী সাথীর বাসা থেকে ৩টি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। সেগুলো সাথী ব্যবহার করতো। পরে কলাবাগান থানা-পুলিশসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট এটা নিয়ে কাজ করে। ঘটনার চার দিনের মাথায় আমরা আসামিকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি।
উপ-পুলিশ কমিশনার বলেন, কলাবাগান থানা-পুলিশ বিভিন্ন স্থানের ৪০০টি সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে। এর কারণ হচ্ছে, ঘটনার পর অভিযুক্ত গৃহকর্ত্রী মোবাইল ফোন বাসায় রেখে বেড়িয়ে গিয়েছিল। এতে গতানুগতিক ধারায় আমাদের তদন্ত করতে হয়েছে। সিসিটিভি ফুটেজে তাকে বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে দেখা গেছে। কখনও মুদি দোকানে, কখনও বিভিন্ন মানুষের ফোন থেকে আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেখা গেছে সাথীকে। মূলত আত্মগোপনে থাকার চেষ্টা করেন তিনি। এক পর্যায়ে আমরা খবর পাই ওই নারী যশোরে অবস্থান করছেন। পরে কলাবাগান থানা পুলিশের একটি দল সেখান থেকে তাকে গ্রেফতার করে।
ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, দা-বটি দিয়ে শিশুটিকে নির্যাতন করা হতো। কখনও লাঠি দিয়েও মারা হয়েছে। শিশুটির অপরাধ ছিল সে গৃহকর্ত্রী সাথীর সন্তানের জন্য রাখা খাবার খেয়ে ফেলতো। খেলার সাথী হিসেবে একজন আরেকজনকে মারতো। এ জন্যও হেনাকে নির্যাতন করা হতো।

গৃহকর্মীকে নির্যাতন না করার অনুরোধ জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের অপরাধ করে কেউ পার পায় না। অভিযুক্ত সাথী স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের একজন সার্ভেয়ার। ২০০৩ সালে সে প্রথমে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেয়। পরে ডিপ্লোমা করে ২০১১ সালে সার্ভেয়ার হিসেবে চাকরি পায়। ২০১৬ সালে বিএসসি পাস করে নিজেকে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবেও পরিচয় দিতেন সাথী।
ডিসি মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন বলেন, সাথীর প্রথম স্বামী ছিলেন একজন ড্রাইভার। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরে চাকরি করা অবস্থায় তার সঙ্গে বিয়ে হয়। সার্ভেয়ার হিসেবে চাকরি হলে তাকে ডিভোর্স দেয় সাথী। পরে ২০১৯ সালে একজন চিকিৎসকের সাথে সম্পর্ক গড়ে দ্বিতীয় বিয়ে করেন সার্থী। পারিবারিক কলহের কারণে ২০২০ সালে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়। এ নিয়ে বিজ্ঞ আদালতে একটি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এ সময় তাদের দুটি জমজ সন্তান জন্ম নেয়। একটি শিশু মারা যায়, আরেকটি জীবিত রয়েছে। সেই শিশুকে লালনপালন ও দেখাশোনা করার জন্যই শিশু হেনাকে গৃহকর্মী হিসেবে তার বাসায় আনা হয়েছিল। শিশু গৃহকর্মী হেনা হত্যায় কলাবাগান থানায় দায়েরকৃত মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার গৃহকর্ত্রী সাথী আক্তার পারভীন ডলিকে বিজ্ঞ আদালতে প্রেরণ করা হয়েছে বলেও জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার (২৫ আগস্ট) রাতে ৯৯৯ এর অজ্ঞাত ফোনে গৃহকর্মী মৃত্যুর প্রাথমিক তথ্য পায় কলাবাগান থানা পুলিশ। এরপর ওইদিন দিবাগত রাত দেড়টার দিকে কলাবাগান থানাধীন সেন্ট্রাল রোডের ৭৭নং ভবনে গিয়ে বেশ কয়েকটি বাসায় খোঁজও নেয় পুলিশ। ওই ভবনটিতে ৪৪টি ফ্ল্যাট রয়েছে। মধ্যরাতে সব ফ্ল্যাটে খোঁজ নেওয়া বেগতিক বুঝে ফিরে যায় পুলিশ। পরদিন সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাড়ি মালিক সোসাইটির লোকজনকে নিয়ে ভবনটির দ্বিতীয় তলা ই-১ ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙে ভেতর থেকে অজ্ঞাত গৃহকর্মী শিশুটির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তার
মৃত্যুর আনুমানিক ২৪ ঘণ্টা পর গত শনিবার (২৬ আগস্ট) সকালে মরদেহ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায়, নিহত শিশুর শরীরের বিভিন্ন স্থানে অনেক নতুন ও পুরোনো আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মুখে ফেনা, শরীর ফোলা। মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হতে মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠায় পুলিশ। এর দু’দিন পর নিহত গৃহকর্মীর পরিচয় শনাক্ত করতে সক্ষম হয় পুলিশ।