সব বাধা পেরিয়ে ১০ সন্তানকে উচ্চশিক্ষিত করেছেন এই রত্নগর্ভা মা

প্রকাশিত: ৫:১৬ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২৪

জেলা প্রতিনিধি,মেহেরপুরঃ 

১০ কিংবা ১২ বছর বয়সেই পরিবারের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছিল নুরজাহান খাতুনকে। বিয়ের পরও তার ইচ্ছে ছিল পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়ার। সেটা হয়ে ওঠেনি। লেখাপড়া শিখতে না পারার কষ্ট বুকে নিয়ে শপথ করেছিলেন ছেলেমেয়েদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। আর সেই আকাঙ্ক্ষা থেকেই তার ১০ সন্তানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন তিনি।

সংগ্রামী মা নুরজাহান খাতুন বলেন, আমার স্বামী মারা যান সড়ক দুর্ঘটনায়। ১০ ছেলেমেয়ে নিয়ে আমি তখন অথৈ সাগরে পড়ি। তবে কখনো ভেঙে পড়িনি। জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করেই ১০ সন্তানকেই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেছি। সবাই এখন চাকরিজীবী।কতটুকু সফল হতে পেরেছি বা জীবন সংগ্রামে কতটুকু জয়ী হয়েছি জানি না, তবে আমার সব সন্তান উচ্চশিক্ষিত ও প্রতিষ্ঠিত।

‘সফল জননী’ হিসেবে নুরজাহান খাতুন গাংনী উপজেলা পর্যায় ও মেহেরপুর জেলা পর্যায় থেকে ইতোমধ্যে স্বীকৃতি হিসেবে ২০২৩ সালে পেয়েছেন জয়িতা ও রত্নগর্ভা পুরস্কার। তার বয়স এখন প্রায় ৮০ বছর। এখনো চশমা ছাড়াই পবিত্র কোরআন শরীফসহ বিভিন্ন বই পড়তে পারেন। বাড়ির সব কাজকর্মও করেন নিজের হাতে। কাজ শেষে নাতি-নাতনির সঙ্গে করেন খুনসুটি। সংগ্রামী এই মায়ের বাড়ি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার গাঁড়াডোব গ্রামে। তিনি মরহুম কোবাদ আলী শেখের স্ত্রী।

নুরজাহান খাতুনের যখন বিয়ে হয়, তখন তিনি গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে তৃতীয় শ্রেণি শেষ করে চতুর্থ শ্রেণিতে উঠেছেন। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে তিনি তিন নম্বর। বাবা মোহাম্মদ আলী ছিলেন একজন কৃষক। বিয়ের সময় তার স্বামী কোবাদ আলী শেখ তখন বরিশাল বিএডিসিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। স্বামীর ঘরে যাওয়ার পর নুরজাহানের লেখাপাড়া বন্ধ হয়ে যায়। চুকে যায় পড়ালেখার স্বপ্ন। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছেলেমেয়েকে পড়াশোনা করিয়ে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করাবেন।

কিন্তু ১৯৯৬ সালে এক সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যান। ১০ সন্তান নিয়ে ভেঙে না পড়ে শক্ত হাতে সংসারের হাল ধরেন নুরজাহান খাতুন। স্বামীর রেখে যাওয়া অল্প কিছু অর্থ দিয়ে প্রথমে বাড়িতেই কয়েকটি ছাগল পালন শুরু করেন। এরপর ধীরে ধীরে হাঁস-মুরগি ও গরুর খামার করেন তিনি। এভাবেই এক এক করেন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করেন ১০ সন্তানকে।

নুরজাহান খাতুনের ১০ ছেলেমেয়ে সবাই মাস্টার্স পাস। তার বড় ছেলে আনিসুর রহমান কুষ্টিয়া জেলা হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা, মেজো ছেলে আনছারুল হক ইসলামিক ফাউন্ডেশন পরিচালিত মসজিদ ভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমের পরিদর্শক, তৃতীয় ছেলে এসএম আইনুল হক বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি ও বর্তমানে সুইডেনে নাগরিকত্ব অর্জন করে সেখানকার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন, চতুর্থ ছেলে মাসুদুজ্জামান গাংনী উপজেলার বাহগুন্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, পঞ্চম মেয়ে নাছিমা খাতুন গাংনী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা, ষষ্ঠ ছেলে শাহাজাহান আলী গাংনী উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিসে সিনিয়র অডিটর, সপ্তম ছেলে আলমগীর হোসেন একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হিসেবে কর্মরত, অষ্টম মেয়ে নাজমা খাতুন মেহেরপুর জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরে প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত, নবম ছেলে জিল্লুর রহমান বেসরকারি প্রাইম ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। কনিষ্ঠ মেয়ে তাসলিমা আক্তার বিসিএস নন ক্যাডারে কুষ্টিয়া ভূমি অফিসে কর্মরত রয়েছেন।

রত্নগর্ভা নুরজাহান খাতুন বলেন, জীবনের সব ক্ষেত্রে আমি সফলতা পেয়েছি। ছেলেমেয়েদের সফলতা এখন আমাকে গর্বিত করে। ছেলেমেয়েদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছি। এখন আমার পরিবারের সবাই চাকরিজীবী। আমার সন্তানদের বলেছি, জীবনে অবহেলিত ও নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে কাজ করতে। সমাজের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।কঠিন সময়ে ভেঙে না পড়ার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, যেকোনো কাজে সদিচ্ছা, সততা, স্বচ্ছতা ও চেষ্টা থাকলে মানুষ সফল হবেই। কারো ওপর নির্ভর না করে নিজের জীবন নিজেকেই গোছাতে হবে। সফল হওয়ার পেছনে এটাই হচ্ছে মূলমন্ত্র।

বাংলাদেশ টেলিভিশনের মেহেরপুর জেলার সাবেক প্রতিনিধি ও বর্তমান সুইডেন প্রবাসী এসএম আইনুল হক সুইডেন থেকে ভিডিও বার্তায় বলেন, আমাদের মা একজন আদর্শ মা। মায়ের অনুপ্রেরণাতেই আজ আমরা সব ভাই-বোন উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। সব কাজকর্ম একা হাতে করেও তিনি সব সময় আমাদের লেখাপড়ার তদারকি করতেন।

মেয়ে নাজমা খাতুন বলেন, মায়ের নির্দেশ ছিল সন্ধ্যায় হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে পড়তে বসা। তিনি শত কাজ করার পরেও পড়ার টেবিলের পাশে বসে ছেলেমেয়েদের পড়ালেখার খোঁজ খবর নিতেন। আমি সন্তানদের উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পাশাপাশি আদর্শবান সন্তান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সব মায়েদের আহ্বান জানাই।

প্রতিবেশী রিক্তা খাতুন বলেন, নুরজাহান খাতুনের সঙ্গে আমার দাদী শাশুড়ি সম্পর্ক। তিনি খুব ভালো মানুষ। তার সব ছেলেমেয়ে শিক্ষিত। সবাই ভালো চাকরি করেন। আমার শাশুড়ির কাছে শুনেছি নুরজাহান খাতুন তার ছেলে মেয়েকে দেখার পাশাপাশি শ্বশুর-শাশুড়িকেও খুব যতœ করতেন। এখন তার পুত্রবধুদেরকে খুব ভালোবাসেন। আমাদের এলাকার প্রতিটি মায়েদের তিনি সন্তাদের লেখাপড়ার কথা বলে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি বর্তমান সমাজের একটি দৃষ্টান্ত।

ছেলে শাহাজান আলী বলেন, সন্ধ্যা হলেই মা আমাদের হারিকেন জ্বালিয়ে দিয়ে উঠানে পড়তে বসাতেন। তিনি রান্না করতেন আর রান্না ঘর থেকে আমাদের পড়ার শব্দ শুনতেন। কেউ চুপ হয়ে গেলে তিনি রান্নাঘর থেকে আমাদের বকাবকি করতেন। তিনি বলতেন- তোমাদের বাবা নেই। বাবার অবর্তমানে তোমাদের মানুষ করার দায়িত্ব আমার। তোমরা দুষ্টামি করলে আমার স্বপ্ন পূরণ হবে না। আমার সব ভাইবোন মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করার চেষ্টা করতাম। এখনও আমার মায়ের কথার বাইরে যাবার সুযোগ নেই।

তার মেয়ে গাংনী উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিসার নাছিমা খাতুন বলেন, আমার মা খুব ভালো মানুষ। তিনি সব বাধা পেরিয়ে একজন সফল নারী। আমার বাবা মারা যাবার পর পরিবারে হাল ধরার মতো কেউ ছিল না। মা একাই ১০ ভাইবোনকে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছেন। বাবা যখন মারা যান আমরা কেউ তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ কলেজে, কেউ মাধ্যমিক নয়তো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। আমাদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে গ্রামের মানুষের কাছেও তাকে শুনতে হয়েছে নানা ধরনের কটু কথা। তারপরেও তিনি থেমে যাননি। সবকিছু উপেক্ষা করে আমাদের মানুষ করেছেন।