সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাঙামাটির ‘বনরুপা বাজার’

প্রকাশিত: ২:২৮ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৫, ২০২৪

রাঙামাটি প্রতিনিধিঃ 

হ্রদ-পাহাড়ের শহর রাঙামাটি বিখ্যাত তার সৌন্দর্য ও রুপের কারণে। সুবিশাল সবুজ পাহাড় আর কাপ্তাই হ্রদে ঘেরা এই জনপদ সবার কাছে পরিচিত এর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের কারণে। পাশাপাশি এখানকার ব্যতিক্রম জীবনযাত্রা রাঙামাটির পাহাড়ি জীবনকে আলাদা করেছে।

এই শহরের প্রাণকেন্দ্র বনরুপায় রয়েছে শহরের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী পাহাড়ি বাজার বনরুপা বাজার। কী নেই এই বাজারে? এই জায়গায় বিক্রি হচ্ছে ফলমূল বা শাকসবজি তার পাশেই পাওয়া যায় ভ্রাম্যমাণ পাহাড়ি পোশাকের দোকান, হয়তো তার পাশেই পসরা সাজিয়েছেন ওষুধ কিংবা প্রসাধনী বিক্রেতা। বাজারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত জীবন চালানোর প্রায় সবকটি উপাদানে পরিপূর্ণ থাকে এই পাহাড়ি বাজারটি। পাহাড়ে বসবাসরত সব জনগোষ্ঠীদের উপস্থিতিতে সরব এই বাজার। সব জনগোষ্ঠীর মিলনমেলায় এই বাজার যেন সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

এটি রাঙামাটি শহরের সবচেয়ে প্রাচীন ও বৃহৎ বাজারগুলোর একটি। কাইন্দ্যা, বন্দুকভাঙ্গা, বালুখালী, বসন্তপাড়া, মাইসছড়ি, নতুনপাড়া, কিল্লামুড়া, নানিয়ারচর, বুড়িঘাটসহ আরও অনেক পাহাড়ি গ্রাম থেকে জুমের উৎপাদিত ফসল নিয়ে বাজারে আসেন পাহাড়িরা। সপ্তাহের ৭ দিন খোলা থাকলেও প্রতি শনি ও বুধবার এখানে হাট বসে। তবে স্থানীয়রা এটিকে হাট না বলে বলেন ‘বাজার বার’।

বাজার বারেই লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে বাজারটি। বাজারের একদম শেষ প্রান্তে রয়েছে ‘সমতা ঘাট’ নামে একটি নৌ-ঘাট। এই নৌ-ঘাটটিই এই বাজারের প্রাণ। পাহাড়ে উৎপাদিত ফলমূল, শাকসবজি থেকে শুরু করে মাছ-মাংস সবকিছুই বোটে করে আনা হয় এই ঘাটে। এই ঘাট থেকেই সেগুলো বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে যাওয়া হয় বাজারে।

বাজার বারের দিনগুলোতে দেখা যায়, ভোর থেকেই ইঞ্জিনচালিত নৌকা করে নিজেদের উৎপাদিত শাকসবজি, ফলমূল নিয়ে ঘাটে ভিড়তে শুরু করেন পাহাড়ি নারী-পুরুষরা। শাকসবজির পাশাপাশি কাপ্তাই হ্রদ থেকে আহরণ করা মাছ ও নিজেদের খামারে উৎপাদিত শূকরের মাংস নিয়েও ভিড় করেন বিক্রেতারা। বোটে করে হাটে বিক্রির জন্য নিয়ে আসা হয় গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগিসহ নানান প্রাণী।

বাজারে বিক্রি হওয়া পাহাড়ি সবজির মধ্যে, বাঁশকোড়ল, পুজক বিচি, তাঁরা, আমিল্য পাদা (টক পাতা), জুম কুমড়া, জুমের বেগুন, জুমকচু, তিত বেগুন, ঠান্ডা আলু, থানকুনি পাতা, হলুদ ফুল, কচু শাক, ধাইন্যা মরিচ, আদা, হলুদ, ঢেঁকি শাক, কলার মোচা অন্যতম।

এসব সবজির অনেকগুলোই বনে জন্ম নেওয়া আবার কিছু জুমের খেতে উৎপাদিত। এছাড়া ড্রাগন ফল, পাহাড়ি মাল্টা, জলপাই, তেঁতুল, পেঁপেসহ নানান পদের ফলমূলের সমারোহ চোখে পড়ে। পাহাড়ে বিপুল পরিমাণ কলা উৎপাদন হওয়াতে বাজারে আলাদা করে কলার বাজার বসে। বিভিন্ন কলার মধ্যে বাংলা কলাই বেশি পাওয়া যায়। গ্রাম থেকে গরুর দুধ বোতল করে এনে বিক্রি করা হয়। পাহাড়িদের গরুর দুধের বেশ সুনাম। তাই বিক্রিও হয় ভালো। বাঁশের দইও বিক্রি হয় বাজারে।

বাজার করতে আসা ক্রেতা শেফালিকা চাকমা বলেন, এই বাজারটির মূল বিশেষত্ব হলো ভেজালমুক্ততা। এখানে বিক্রি হওয়া প্রায় প্রতিটি শাক-সবজি, ফল-মূল, মাছ-মাংসে কোনো ধরনের ভেজাল মিশানো হয় না। পাশাপাশি সবকিছুই তাজা পাওয়া যায়। হাটের দিনগুলোতে নানান পদের তাজা শাক-সবজির পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের চাল, আদা, হলুদসহ বিভিন্ন মশলাও পাওয়া যায়। যেসব পাহাড়ি সবজি বা ফলগুলো সচরাচর পাওয়া যায় না।

আরেক ক্রেতা দয়াধন চাকমা বলেন, এখানে সপ্তাহে দুই দিন শনি ও বুধবার বাজার হয়। তবে আমাদের পাহাড়িদের জন্য বুধবারের বাজারটাই মূল। দূর-দূরান্ত থেকে পাহাড়িরা এখানে বিভিন্ন সবজি, ফল, মাংস নিয়ে আসেন বিক্রি করতে। সেগুলোতে কোনো ভেজাল মেশানো হয় না বলে আমরা এখান থেকে কেনাকাটা করে খুব শান্তি পাই। এই বাজারটি পাহাড়ি বাঙালিদের একটি মিলনমেলাও বটে।

বনরুপা বাজার নানান পদের মাছ মাংসের জন্যও বিখ্যাত। একমাত্র এখানেই পাওয়া যায় বন্য শূকরের মাংস। পাশাপাশি খামারে চাষ করা শূকর, ব্যাঙ, কুইচ্চা, সাপসহ নানান প্রাণীর মাংস বিক্রি হয়, তবে শূকরের মাংস বিক্রি হয় বেশি। কাপ্তাই হ্রদ হতে আহরণ করা তাজা মাছ পাওয়া যায় বাজার বারে। লেকের চাপিলা, কাচকি, মলা, টেঙরা, বাইন, বাইলা, রুই, তেলাপিয়াসহ আরও বিভিন্ন রকমের মাছ রয়েছে বাজারে। মাছ-মাংসের পাশাপাশি বিক্রি হয় শামুক। এটি পাহড়িদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার। প্রতি কেজি ২০০-২৫০ টাকায় পাওয়া যায় শামুক। রয়েছে শুকনো মাছ, নাপ্পি, সিদল, মহিষের চামড়া সহ নানান পাহাড়ি খাবার। কাঁচা চিংড়ি রোদে শুকিয়ে এরপর গুড়ি করে পানি, লবণ ও আরো কিছু উপকরণ মিশিয়ে তৈরি করা হয় নাপ্পি। এটি তরকারির স্বাদ বাড়াতে ব্যবহৃত হয়। এসবের পাশাপাশি রয়েছে নানান পদের শুটকি ও মুদি দোকান। জুমে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের চালও পাওয়া যায় বাজারে।

বাজারে পণ্য বিক্রি করতে আসা পাহাড়ি নারী শোভা চাকমা বলেন, আমি আমার খেতে উৎপাদিত আলু, কচু ও শাক নিয়ে এসেছি। প্রতি সপ্তাহেই বাজারে আমি কিছু না কিছু নিয়ে আসার চেষ্টা করি। এখানে বেচা-বিক্রি মোটামুটি ভালো হয়।

আরেক বিক্রেতা কলাই চাকমা বলেন, আমি শামুক, মহিষের চামড়া ও ক্ষীরা নিয়ে এসেছি। শামুক ২০০ টাকা, মহিষের চামড়া ১৫০ টাকা এবং ক্ষীরা ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করছি। শনি বুধবার বাজার বারে ভালো বিক্রি হয়। শাক-সবজি, মাছ-মাংসের পাশাপাশি পাওয়া যায় প্রসাধনী ও টর্চ, ব্যাটারি ও সোলার সিস্টেমসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় উপকরণ। পাহাড়ি অনেক গ্রামে বিদ্যুৎ না পৌঁছানোর কারণে তারা সোলার এবং ব্যাটারির উপরই নির্ভরশীল। সেসব কেনা ও মেরামতের ব্যবস্থা রয়েছে বাজারে। পার্বত্য জনপদের এই বিখ্যাত বাজারটি সুপরিচিত হয়ে উঠুক দেশবাসীর কাছে এমনটাই আশা করেন ক্রেতা-বিক্রেতারা।