নিজস্ব প্রতিবেদক:

গত এক দশকে ইন্টারনেট ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের ফলে সাংবাদিকতা জগতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। সংবাদ সংগ্রহ থেকে প্রচারের ধরন পর্যন্ত বদলে গেছে। সংবাদমাধ্যমগুলো এখন আর শুধু প্রিন্ট বা টেলিভিশনের ওপর নির্ভরশীল নয়। অধিকাংশ সংবাদমাধ্যম অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সোশ্যাল মিডিয়া এবং মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে দ্রুত খবর পৌঁছে দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এখন আর কেউ পরদিনের পত্রিকার অপেক্ষায় থাকেন না—দিনের খবর পাঠক দিনেই জেনে যাচ্ছেন, এমনকি মুহূর্তের খবর মুহূর্তেই পাচ্ছেন।

সোশ্যাল মিডিয়া ও সাংবাদিকতা
সোশ্যাল মিডিয়া ও স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার ফলে সাধারণ মানুষও সাংবাদিকতার অংশ হয়ে উঠেছে। মুহূর্তেই ঘটনাস্থল থেকে তথ্য ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা হচ্ছে, যা প্রথাগত সংবাদমাধ্যমের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। অনেক সময় সাংবাদিকরাও সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্যের ওপর নির্ভর করছেন, এমনকি যাচাই না করেই তা সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করছেন

ভুয়া খবরের চ্যালেঞ্জ
ইন্টারনেটের সহজলভ্যতায় এখন চারদিকে ভুয়া খবরের ছড়াছড়ি। কখনো কোনো তারকার মৃত্যু বা বিয়ের ভুয়া সংবাদ, কখনো ধর্মান্তরের খবর, কখনো দুর্ঘটনা বা রোগে ব্যাপক মৃত্যুর গুজব—এসব বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পাঠকও অনেক সময় না বুঝেই এগুলো শেয়ার করছেন। ফলে সাংবাদিকদের দায়িত্ব এখন শুধু খবর প্রচার করা নয়, বরং সত্যতা যাচাই করে সঠিক তথ্য পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া।

প্রথাগত ও ডিজিটাল সাংবাদিকতার মিশ্রণ
বর্তমানে শুধু অনলাইন নিউজ পোর্টাল নয়, দেশের বড় সংবাদপত্র ও বেসরকারি টেলিভিশনেরও নিজস্ব নিউজ পোর্টাল রয়েছে। তারা মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট তৈরি করছে, লাইভ সম্প্রচার করছে, এমনকি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে সক্রিয়। এতে টেলিভিশন ও ডিজিটাল সাংবাদিকতা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

প্রিন্ট মিডিয়ার সংকট
গত এক দশকে ডিজিটাল মিডিয়ার প্রসারের ফলে ছাপা পত্রিকার প্রচারসংখ্যা ব্যাপকভাবে কমেছে। পাঠক টানতে ইংরেজি দৈনিকগুলোকেও এখন বাংলায় সংবাদ প্রকাশ করতে হচ্ছে। এমনকি অনেক জনপ্রিয় রেডিও বন্ধ হয়ে গেছে, যেমন ২০২২ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিবিসি বাংলা তাদের ৮১ বছরের রেডিও সম্প্রচার বন্ধ করে। তবে তারা অনলাইন ও টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যতিক্রমী কনটেন্টের মাধ্যমে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছে।

সাংবাদিকতার সংখ্যা ও নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান
তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দেশে নিবন্ধিত অনলাইন নিউজ পোর্টালের সংখ্যা ২১৩টি, দৈনিক পত্রিকা ১,৩১১টি এবং অনুমোদিত বেসরকারি টেলিভিশন ৪৫টি। এর মধ্যে ১৭টি বেসরকারি টেলিভিশন ও ১৯৬টি দৈনিক পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল নিবন্ধন পেয়েছে।

তবে এর বাইরেও অসংখ্য অনিবন্ধিত অনলাইন পোর্টাল ও ইউটিউব চ্যানেল সংবাদ প্রচার করছে, যা অনেক সময় পাঠকদের বিভ্রান্ত করছে। ফলে সাংবাদিকদের আরও সতর্ক হতে হবে, যাতে ভুল তথ্য ছড়িয়ে না পড়ে।

ডিজিটাল যুগে সাংবাদিকতার চ্যালেঞ্জ
সোশ্যাল মিডিয়া ও সাংবাদিকতা
সোশ্যাল মিডিয়া এখন সাংবাদিকতার অন্যতম শক্তিশালী মাধ্যম। ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম এবং টিকটকের মাধ্যমে দ্রুত সংবাদ পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে। তবে এসব প্ল্যাটফর্মের অ্যালগরিদম ও ফিল্টার বাবল অনেক সময় সঠিক তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।

সিটিজেন জার্নালিজম ও সত্যতা যাচাই
সিটিজেন জার্নালিজমের ফলে যে কেউ এখন খবর সংগ্রহ ও শেয়ার করতে পারছে। এটি গণমাধ্যমের জন্য সুবিধা হলেও, তথ্য যাচাই করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ব্রেকিং নিউজ ও সত্যতা নিশ্চিতকরণ
ব্রেকিং নিউজ মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে, যা পাঠকদের আপডেট রাখতে সাহায্য করে। তবে এতে ভুল তথ্য প্রকাশের ঝুঁকি বাড়ছে, তাই সংবাদমাধ্যমগুলোকে যথাযথ তথ্য যাচাই করতে হবে।

ভুয়া খবর প্রতিরোধ
সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে গুজব বা ভুয়া তথ্য দ্রুত ছড়ায়, যা জনমতকে প্রভাবিত করতে পারে। সংবাদমাধ্যমগুলোকে তাই ফ্যাক্ট-চেকিং এবং যাচাই প্রক্রিয়ায় আরও কঠোর হতে হবে।

সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও গোপনীয়তা
তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ। সাংবাদিকদের অবশ্যই নৈতিক মানদণ্ড বজায় রেখে কাজ করতে হবে।

মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট ও নতুন ফরম্যাট
বর্তমানে সাংবাদিকতা মাল্টিমিডিয়া কনটেন্টের ওপর নির্ভরশীল। পাঠকরা শুধুমাত্র লেখা নয়, ভিডিও, অডিও ও ইনফোগ্রাফিক্সের মাধ্যমে খবর উপভোগ করতে চান। ফলে সংবাদমাধ্যমগুলোকেও সৃজনশীল হতে হচ্ছে।

ভবিষ্যতের সাংবাদিকতা ও প্রযুক্তির ভূমিকা
সাংবাদিকতা এখন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি ভবিষ্যতে সাংবাদিকতার ধরন বদলে দেবে। এসব প্রযুক্তির মাধ্যমে সংবাদ তৈরি, বিতরণ ও উপস্থাপনা আরও সহজ হবে। তবে এর পাশাপাশি সাংবাদিকতার নৈতিকতা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বজায় রাখার চ্যালেঞ্জও থাকবে।

ডিজিটাল যুগে সাংবাদিকতা আরও প্রযুক্তিনির্ভর হবে, তবে সঠিক তথ্য যাচাই, গোপনীয়তা রক্ষা ও নৈতিকতার মান বজায় রাখা সাংবাদিকতার ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকবে।