সাফল্য কাঁদাচ্ছে সবাইকে, থামছে না পরিবারের আহাজারি

প্রকাশিত: ১২:৩৮ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ১৭, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা হয়েছে মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর)। উত্তীর্ণদের বেশির ভাগের পরিবারেই এখন বইছে আনন্দের বন্যা। কিন্তু অনেকের ভালো ফল তাদের পরিবারে কোনো আনন্দ বয়ে আনেনি, আনন্দের পরিবর্তে পরিবারগুলোতে এখন শুধুই কান্না আর আহাজারি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের মধ্যে ১১ জন এইচএসসি শিক্ষার্থী এবার উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের পরিবারের সদস্যদের আরেক দফা শোকের সাগরে ভাসিয়েছে এ ফল। স্বপ্নভাঙার বেদনায় নীল হয়েছেন শহীদদের বাবা-মা, ভাই-বোন, শিক্ষক-সহপাঠী। তাদের এই সাফল্য কাঁদাচ্ছে সবাইকে
হতাশাগ্রস্ত জাতির বুকে আশা, মৌন-মলিন মুখে ভাষা জোগাতে লেখাপড়া ফেলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী রাজপথে আন্দোলনে নেমেছিলেন। এক নদী রক্তে কর্তৃত্ববাদী শাসনের বন্দিশালার শিকলভাঙা এ অভ্যুত্থানকারীদের মধ্যে ছিলেন হাজার হাজার এইচএসসি কিংবা আলিম পরীক্ষার্থী, যারা পরীক্ষার মাঝপথে আন্দোলনে যোগ দেন। তাদের মধ্যে অন্তত ১৫ পরীক্ষার্থী প্রাণ দিয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জন পরীক্ষায় পাশ করেছেন।

সবুজের ভালো ফলের পরও থামছে না পরিবারের কান্না: শেরপুর জেলা শহরের খরমপুর মোড়ে ৪ আগস্ট আওয়ামী দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন সবুজ মিয়া। এবার এইচএসসি পরীক্ষায় ৪.৩৩ পেয়েছেন। সেদিনের পর থেকে পরিবারের কারো মুখে নেই হাসি। মঙ্গলবার রেজাল্ট শুনে আরো শোকাহত হন তারা। থামছে না কান্না। শ্রীবরদীর খড়িয়া কাজিরচর ইউনিয়নের রুপারপাড়া গ্রামের প্যারালাইজড রোগী আজাহার আলীর ছেলে সবুজ। তার আয়েই চলত পাঁচ সদস্যের পরিবার। তাকে হারিয়ে পরিবারটি এখন দিশেহারা। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে সবুজ ছিলেন দ্বিতীয়। বড় বোনের বিয়ের পর বাবা প্যারালাইজড হন। এরপর পরিবারের দায়িত্ব নেন তিনি। স্থানীয় এক ফার্মেসিতে সেলসম্যানের কাজ করতেন সবুজ। পাশাপাশি পড়াশোনা করতেন শ্রীবরদী সরকারি কলেজে। সবুজের মা সমেজা বেগম বলেন, এ রেজাল্ট তো আমাদের কোনো কাজে আসবে না। আমরা চাই প্রকৃত দোষীদের দ্রুত ন্যায়বিচার।

ইঞ্জিনিয়ার হতে চেয়েছিলেন সাগর: পটুয়াখালীর গলাচিপার উলানিয়া হাট মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন সাগর গাজী। মো. সিরাজুল গাজী ও শাহিদা বেগম দম্পতির তিন ছেলের মধ্যে ছোট তিনি। জিপিএ ৩.৯২ পেয়েছেন। এদিন তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মা শাহিদা বেগম থেমে থেমে বিলাপ করছিলেন। বলছিলেন, ‘আইজগো আমার পুতে কত খুশি হইতো। আইজগো কত কথা কইতে মায়ের লগে।’ তিনি বলেন, আমাকে বলত, মা আমি ইঞ্জিনিয়ার হব। পরিবারের দুঃখকষ্ট ঘোচাব। আমাকে বলল, মা আমি আন্দোলনে অংশ নিতে ঢাকায় যাব। আমরা যেতে না করলে সে জোর করে যায়। সাগরের বড় ভাই বলেন, শহীদদের রক্তের সঙ্গে কেউ যেন বেইমানি না করতে পারে।

রায়হান বেঁচে নেই, এই ফল দিয়ে কী হবে: ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে গুলিতে নিহত হন মো. রায়হান। তিনি নোয়াখালী সদর উপজেলার পূর্ব দুর্গানগর গ্রামের আমজাদ হাজি বাড়ির মো. মোজাম্মেল হোসেন ও আমেনা বেগম দম্পতির একমাত্র ছেলে। মোজাম্মেল বাড্ডায় এক বাড়িতে কেয়ারটেকারের চাকরি করতেন। রায়হান পাশেই মেসে থাকতেন। তিনি রাজধানীর গুলশান কমার্স কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নেন। বোন ঊর্মি আক্তার বলেন, আমার ভাই মেধাবী ছাত্র ছিল। তার আচার-আচরণও ভালো ছিল। তার জন্য বাবা-মা সব সময় কান্না করেন। আজ পরীক্ষার ফল শুনে বাবা-মা আরো বেশি কান্না করছেন। মা আমেনা খাতুন বলেন, সে পাশ করছে, তা দিয়ে এখন কী করব। তাকে ঢাকায় পড়ালেখা করিয়েছি। তার অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন বুলেটে শেষ হয়ে গেছে।

শাহরিয়ারের মৃত্যুতে নিভে গেল বংশের বাতি: ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার বিন মতিন জিপিএ ৪.৮৩ পেয়েছেন। শাহরিয়ারের বাবা আব্দুল মতিন একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করতেন। মা মমতাজ বেগম হবিগঞ্জের মাধবপুর শাহজালাল মাধবপুর কলেজের সাবেক প্রভাষক। তাদের গ্রামের বাড়ি ঈশ্বরগঞ্জের মাইজবাগ ইউনিয়নের কুমড়াশাসন গ্রামে। শাহরিয়ার খালার বাসায় গিয়েছিলেন। ফেরার পথে ১৮ জুলাই মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সামনে গুলিবিদ্ধ হন। শাহরিয়ারের চাচা আব্দুল মোতালিব বলেন, আমার ভাই আব্দুল মতিন ও ভাবি মমতাজ বেগম ওমরাহ পালনে সৌদি আরব রয়েছেন। শাহরিয়ার বেঁচে থাকলে আজ কতই না আনন্দ পেতাম। ডুকরে কেঁদে উঠে তিনি বলতে থাকেন, ‘আমাদের দুই ভাইয়ের সংসারে একমাত্র পুত্রসন্তান ছিল শাহরিয়ার। তার মৃত্যুতে আমাদের বংশের বাতিই নিভে গেল।’