সুস্থ থাকতে রোজায় ঘরে তৈরি খাবার খাওয়ার পরামর্শ চিকিৎসকদের

প্রকাশিত: ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ২, ২০২৫

সাজ্জাদ হসেন:

 

মুসলমানদের সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান শুরু হয়েছে। রমজান মাসকে ঘিরে প্রতিবছর রাজধানীসহ সারা দেশে প্রচুর ইফতারজাতীয় খাবার বিক্রি হয়। সেই সুযোগে মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত লাভের আশায় ইফতারি তৈরিতে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর মুখরোচক খাবার অতি চড়া মূল্যে বিক্রি করেন। এসব ক্ষতিকর খাদ্যসামগ্রী মানুষের গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হচ্ছে। খাদ্যে বিষাক্ত ও ভেজাল সামগ্রী ব্যবহারের কারণে পেটের পীড়া, আলসার, ক্যানসার, হৃদরোগসহ নানা অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয় মানুষ। জনগণের সুস্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে স্বাস্থ্যসম্মত ইফতারি এবং ভেজাল ও বিষমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করা জরুরি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

ইফতারিতে বেশি চাহিদা থাকে মুড়ির। সেই মুড়িকে সাদা করতে ব্যবহৃত হয় ট্যানারির বিষাক্ত রাসায়নিক সোডিয়াম হাইড্রো সালফাইড। মুড়ি বড় দানায় পরিণত করতে ব্যবহার হয় ইউরিয়া সার। মুড়িতে মেশানো এই ক্ষতিকর উপাদান পেটে গেলে আলসার, মানব দেহে রক্তের শ্বেতকনিকা, হিমোগ্লোবিনের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়। জিলাপি দীর্ঘক্ষণ মচমচে রাখতে তেলের সঙ্গে মবিল মেশানো হয়। আর ভাজাপোড়ায় ব্যবহৃত তেল কড়াই থেকে তিন-চার দিনেও ফেলা হয় না। এসব দিয়ে তৈরি খাবার পেটের পীড়া, কিডনি ও যকৃত সমস্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। বেগুনি, পিঁয়াজু, চপ দৃষ্টি আকর্ষণীয় করতে ব্যবহার করা হয় কেমিক্যাল রং। কম খরচে বেশি লাভের আশায় এক শ্রেণির ইফতার বিক্রেতা ‘ফুড কালার’র পরিবর্তে ব্যবহার করে কাপড়ে ব্যবহৃত রং। জানা যায়, এক কেজি টেক্সটাইল কালারের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ৩০০ টাকা। সেখানে এক কেজি ফুড কালারের মূল্য প্রায় ১০ হাজার টাকা। খাদ্যে মেশানো কাপড়ের রং স্বল্প সময়ে কিডনি ও লিভারে আক্রান্ত করে, দীর্ঘমেয়াদে মানবদেহে ক্যানসারের মতো রোগ সৃষ্টি করে।

মিষ্টি জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে ব্যবহৃত হয় ভেজাল চিনি। এর রাসায়নিক নাম সোডিয়াম সাইক্লামেট। মিষ্টি জাতীয় দ্রব্যকে অধিকতর মিষ্টি করতে ব্যবহার করা হয় স্যাকারিন, সুকরালেস ইত্যাদি। জিলাপিতে বিষাক্ত কেমিক্যাল সামগ্রীর পাশাপাশি ‘বাসন্তি রং’ ব্যবহার করা হয়। ফলে সাধারণ জিলাপির চেয়ে এসব জিলাপি বেশি উজ্জ্বল দেখা যায়।

ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ ইত্তেফাককে বলেন, ইফতারির খাবারটা আমাদের ঐতিহ্যবাহী। খাবার খেতে কোনোই মানা নাই। যারা সুস্থ পেটের কোনো রোগ নাই, তারা খেতে পারেন। তবে এসব খাবার যেন টাটকা ভেজালমুক্ত হয়। অভিজ্ঞ এই চিকিৎসক জোড় দিয়ে বলেন, বাইরের রাস্তা-ঘাটের খোলামেলা খাবার খাবেন না; নিজের ঘরে তৈরি খাবারটাই খাবেন। বাইরের এসব খাবার খেলে শরীরই শুধু খারাপ করবে। আর যাদের এসিডিটি আছে, পেটের সমস্যা আছে, আইবিএস আছে, তারা বুঝে শুনে ইফতারির ভাজা-পোড়া খাবার খাবেন। টাটকা খাবারটা খাবেন, খেয়ে হজম করতে পারলে ভালো, কোনো অসুবিধা নাই। এছাড়া যারা পেটের পীড়া বা অন্যান্য অসুখে ভুগছেন তারা একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে খাবেন; সেটা সবচেয়ে ভালো হয়। বাইরের খোলা খাবার পরিহার করা সবার জন্য জরুরি। তেলে ভাজা খাবারের ক্ষেত্রে তেলটা ফ্রেস হতে হবে বলে জানান এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক।

পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী ইত্তেফাককে বলেন, আমরা রোজায় ১১ থেকে ১২ ঘণ্টা অনাহারী থাকি। এই দীর্ঘ সময় খাবার গ্রহণ না করে যখন সন্ধ্যায় আমরা ইফতার করব, তখন দুটো বিষয় দেখতে হবে—প্রথমত পাকস্থলী দীর্ঘক্ষণ খাবার না পেয়ে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ভিন্নতর থাকবে; এ কারণে আমরা যে খাবারগুলো খাবো তা যেন পাকস্থলিবান্ধব হয়, অর্থাৎ পাকস্থলীর যেন কোনো ক্ষতি না করে। সে কারণে আমরা ডিপফ্রাই বা গাঢ় ভাজা খাবার, বেশি ঝাল খাবার বা মশলা যুক্ত খাবার অথবা কৃত্রিম রং যুক্ত খাবার, যেটা খাবারের ক্যাটাগরি না—সেসব খাবার যদি আমরা খাই, সেটি পাকস্থলীর সঙ্গে বন্ধুভাবাপন্ন আচরণ করবে না। এটি একদিকে পাকস্থলীর ভেতরে এসিডের যে ভারসাম্য থাকে, সেটাকে বিঘ্নিত করে, অন্যদিকে পাকস্থলীর ভেতরের যে আবরণী পর্দা সেসব জায়গাকে ক্ষতবিক্ষত করে। এটি বুক জ্বালাপোড়া, বমিভাব, পেট ফাপা, খাবারে অস্বস্তি হবে। অন্য দিকে হজমে গন্ডগোল হবে এবং বেশিদিন খেলে আলসার জাতীয় সমস্যা দেখা দিবে। এ কারণেই আমরা বলব, ইফতারির শুরুতে যেমন পানি খাব এবং যে খাবারগুলো সহজে হজম হয় সেই খাবারগুলো খাব। গুরুপাক বা যে খাবার হজম করতে কষ্ট হয় যেমন কড়া ভাজা খাবার, তৈলাক্ত খাবার, চর্বি জাতীয় খাবার, অথবা অতিরিক্ত রং বা পিজারভেটিভ দেওয়া খাবার আমরা খাব না এবং বেশি ঝাল-মশলা দেওয়া খাবারও আমরা খাব না।