সোনার দাম আকাশ ছোঁয়া, চব্বিশে ৫৬ বার সমন্বয়েও বাজারে অস্থিরতা

প্রকাশিত: ২:২৩ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ৩০, ২০২৪

সেলিনা আক্তার:

প্রাচীনকাল থেকে প্রাচুর্য প্রদর্শনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক লেনদেনেও গুরুত্ব বহন করে চলেছে স্বর্ণ বা সোনা। সোনাকে বলা হয় অর্থের সবচেয়ে স্থায়ী রূপ। কখনও কখনও একটু-আধটু কমলেও সারা বিশ্বে মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়েই চলেছে। বাংলাদেশেও তার ব্যত্যয় হয়নি। যেভাবে সোনার দাম বাড়ছে তাতে ক্রেতাদের একটি বড় অংশের কাছে সোনার অলংকার বানানো দুঃস্বপ্নের পর্যায়ে চলে গেছে।

মহবংিদৈনিক ইত্তেফাকের সর্বশেষ খবর পেতে এড়ড়মষব ঘবংি অনুসরণ করুন
দেশের বাজারে এই বছরের পুরো সময়টাই সোনার দাম ছিল লাখ টাকার ওপরে। যদিও দামি এই ধাতু সোয়া লাখের ঘর পাড়ি দিয়েছে দুই মাস আগেই। চলুন জেনে নেওয়া যাক কতখানি উঠেছে এই বছর স্বর্ণের দামের পারদ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৬ বার সোনার দাম সমন্বয় করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস)। এর মধ্যে দাম কমানো হয় ২৪ বার আর দাম বাড়ানো হয়েছে ৩২ বার।

এ বছরের ১৯ জানুয়ারি থেকে হলমার্ক করা ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়ে হয় ১ লাখ ১২ হাজার ৪৪১ টাকা। তাতে ভরিপ্রতি দাম ১ হাজার ৪০০ টাকা বেড়ে বছরের প্রথম রেকর্ড উচ্চতায় ওঠে। সেদিন থেকে হলমার্ক করা ২১ ক্যারেট সোনার দাম ১ হাজার ২৮৩ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৭ হাজার ৩০৯ টাকা ভরি। ১৮ ক্যারেট মানের সোনার দাম ভরিতে ১ হাজার ১৬৬ টাকা বাড়ে। তাতে এই মানের সোনার নতুন দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৯২ হাজার ২৯ টাকায়। আর সনাতন পদ্ধতির সোনার দাম ৯৩৩ টাকা বেড়ে প্রতি ভরি দাঁড়ায় ৭৬ হাজার ৬৩২ টাকায়।

এ বছরের শেষ সোনার দাম বাড়ে ২৯ ডিসেম্বর। পর দিন ৩০ ডিসেম্বর সোমবার থেকে হলমার্ক করা প্রতি ভরি ২২ ক্যারেট সোনা ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৮৮ টাকায় বিক্রি হয়। এ ছাড়া প্রতি ভরি ২১ ক্যারেট সোনা ১ লাখ ৩২ হাজার ১ টাকা এবং ১৮ ক্যারেট ১ লাখ ১৩ হাজার ১৪১ টাকায় বিক্রি হয়। সনাতন পদ্ধতির প্রতি ভরি সোনার দাম দাঁড়ায় ৯২ হাজার ৮৬৯ টাকায়।

হিসাব করে দেখা গেছে, শুধু গত এক বছরেই ২২ ক্যারেটের প্রতি ভরি সোনার দাম বেড়েছে ২৫ হাজার ৮৪৭ টাকা। গত ৩১ অক্টোবর দেশের বাজারে সোনার প্রতি ভরির সর্বোচ্চ দাম ছিল ১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২৬ টাকা। এরপরও কয়েক দফা দাম ওঠানামা করে।

অথচ বাংলাদেশ স্বাধীনের আগের বছর সোনার ভরি ছিল ১৫৪ টাকা। ১৯৭৩ সালে ছিল ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। ২০০০ সালে সোনার ভরি বেড়ে ৬ হাজার ৯০০ টাকায় দাঁড়ায়। ২০১০ সালে মূল্যবান এই ধাতুর দাম বেড়ে ভরি ৪২ হাজার ১৬৫ টাকা হয়। ২০২০ সালে সোনার ভরি ৬৯ হাজার ৮৬৭ টাকায় পৌঁছায়।

বাজুসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৩ সালে ২৯ বার সোনার দাম সমন্বয় করা হয়। এর মধ্যে দাম কমানো হয় ১১ বার, বাড়ানো হয় ১৮ বার। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর সোনার দাম বেড়ে ১ লাখ ১১ হাজার ৪১ টাকায় পৌঁছায়, যা ছিল ওই বছরের সর্বোচ্চ স্বর্ণের দাম।

দাম বাড়ার সম্ভাব্য কারণ:
সোনার দামের সঙ্গে বিশ্ব অর্থনীতির একটি সম্পর্ক আছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে আগামী দিনগুলোতেও অনিশ্চয়তা এবং ঝুঁকি থাকবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে। ইসরায়েল–ফিলিস্তিন যুদ্ধ সেই অনিশ্চয়তার পালে কিছুটা হলেও হাওয়া দিয়েছে। যত বেশি অনিশ্চয়তা, তত বেশি সোনা বিক্রি। যত বেশি মূল্যস্ফীতি, তত বেশি সোনার মূল্যবৃদ্ধি। ঐতিহাসিকভাবেও দেখা গেছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির সময়েই সোনার দাম সবচেয়ে বেশি বাড়ে। এমন নয় যে, সোনার দাম কেবল লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছেই। মাঝেমধ্যে কমছেও। এটাও অনিশ্চয়তার ফল। সুদের হার বাড়ানো নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতা বা অর্থনীতি মন্দায় আক্রান্ত হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার ওপরও নির্ভর করছে সোনার দামের ওঠানামা।

ডলারের মূল্যবৃদ্ধিও দাম বাড়াতে ভূমিকা রাখে:
দুই বছর আগে বাংলাদেশে ১ ডলারের জন্য গুনতে হতো ৮৫ টাকা। এখন লাগে ১২৯ টাকা। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বব্যাপীই ডলারের রমরমা অবস্থা। বিশ্বের বেশিরভাগ প্রধান মুদ্রা ডলারের বিপরীতে মূল্যমান হারিয়েছে। ফলে ডলার অনেক দেশের জন্যই বিপদের কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে। ডলারের ওপরে আস্থা কমে গেলে অনেকেই সোনার দিকে ঝুঁকে পড়বে। জ্বালানি তেলের কেনাবেচার সঙ্গেও সোনার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের দাম বাড়লে সোনার দামও বেড়ে যায়। কারণ, তখন অনেক দেশই সোনার বিনিময়ে জ্বালানি তেল বিক্রি করে থাকে। আর যেহেতু এখন ডলারের কারণে বিশ্বের মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা চলছে, ফলে বিনিময় মাধ্যম হিসেবে সোনার চাহিদাও বাড়ছে।