স্কুলে যান না তবু্ও নিয়মিত বেতন তোলেন সহকারী প্রধান শিক্ষিকা

প্রকাশিত: ১১:২৪ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৫, ২০২৩

নওগাঁ প্রতিনিধি:

নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার বেগুন জোয়ার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা নিয়মিত স্কুলে যান না বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে স্কুলের হাজিরা খাতায় তাকে নিয়মিত উপস্থিত দেখানো হয়। গত ছয় বছর ধরে মাসে দুই-তিন বার স্কুলে গিয়ে পুরো সপ্তাহের সই একবারে করেন তিনি। আবার কখনো সহকারী শিক্ষক ও অফিস সহকারীর মাধ্যমে হাজিরা খাতা বাসায় নিয়েও সই করেন। আর এভাবেই সরকারি কোষাগার থেকে লাখ লাখ টাকা উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে পাপিয়া সুলতানার বিরুদ্ধে। একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু সাদাত শামীম আহমেদ তার স্বামী। এছাড়া ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আ স ম শফি মাহমুদের ছত্রছায়ায় পাপিয়া এ অনিয়মের সুযোগ পেয়েছেন বলে অভিযোগ অন্যান্য শিক্ষক এবং এলাকাবাসীর।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়, স্কুলের শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৮৫ জন। এছাড়া শিক্ষক ও কর্মচারীর সংখ্যা ১৫ জন। গত ২০১৪ সালে ৫ ফেব্রুয়ারি বিদ্যালয়ে সহকারী প্রধান শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন পাপিয়া সুলতানা। যোগদানের পাঁচ মাস পর কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব ও আর্থিক অনিয়মের কারণে তাকে দেড় বছর স্কুলের বাইরে থাকতে বলা হয়েছিল। পরবর্তী কমিটির সভাপতি পক্ষে থাকায় আবার স্কুলমুখী হন তিনি। তবে নিয়মিত স্কুলে যান না পাপিয়া। মাসে দুই-তিনদিন স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতায় পুরো সপ্তাহের সই করে চলে আসেন। স্কুলে নিয়মিত না যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা তাকে ঠিকমতো চেনেও না। কিন্তু মাস শেষে বেতন বিলের কাগজে পুরো মাসের সই থাকে। সভাপতি ও প্রধান শিক্ষকের সইয়ে বেতন ওঠে। নিয়মিত স্কুলে না গিয়েও সরকারি কোষাগার থেকে বেতন তোলায় অন্য শিক্ষকসহ এলাকাবাসী বিষয়টি নিয়ে নানান প্রশ্ন তুলেছেন।

এক মাস আগেও প্রধান শিক্ষকের ভয়ে স্কুলের সহকারী শিক্ষকরা মুখ খোলার সাহস পেতেন না। কিন্তু গত ৫ জুলাই প্রধান শিক্ষক আবু সাদাত শামীম আহমেদ ও একই স্কুলের সহকারী আরেক শিক্ষিকার বিরুদ্ধে অফিস কক্ষে অসামাজিক কর্মকাণ্ডের অভিযোগে ওই দুইজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এরপর থেকেই বিদ্যালয়টির সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়ার অনিয়ম নিয়ে অন্যরা মুখ খুলতে শুরু করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চলতি মাসের ১ আগস্ট পাপিয়া সুলতানা স্কুলে গিয়ে হাজিরা খাতায় সই করেন। পরে এলাকাবাসীর তোপের মুখে স্কুল থেকে চলে যেতে বাধ্য হন। এরপর তিনি আর স্কুলে যাননি। তার সইয়ের জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। গত জুলাই মাসে ঈদের ছুটি থাকায় ১০ তারিখে স্কুল চালু হয়। তিন দিনের সই একবারে করেছেন তিনি। এরপর ১৩ তারিখ থেকে পরবর্তী তারিখগুলো ফাঁকা রয়েছে। ফাঁকা ঘরে যেন সই করতে না পারেন সেজন্য শিক্ষা অফিসার সেখানে লম্বা করে টান দিয়ে রেখেছেন।

বিদ্যালয়ের ষষ্ট শ্রেণির কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, এ পর্যন্ত সহকারী প্রধান শিক্ষিকাকে তিনদিন স্কুলে আসতে দেখেছে তারা। তার একটা ক্লাসও করেছে। তারপর আর দেখা হয়নি।

প্রতিষ্ঠানটির অফিস সহকারী আবু সাঈদ বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা নিয়মিত স্কুলে আসেন না। আবার যখন স্কুলে আসেন পুরো মাসের অনুপস্থিতির জায়গায় একবারে সই করতেন। অনেক সময় আমাকে এবং সহকারী শিক্ষক জামিল হোসেনকে দিয়ে তাদের নওগাঁ শহরের বাসায় খাতা নিয়ে সই করতেন। যদি আমাদের বেতন আটকে দেয় এই ভয়ে আমরা কিছু বলতে পারতাম না।

বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক জুয়েল হোসেন বলেন, সহকারী প্রধান শিক্ষিকার স্বামী আমাদের প্রধান শিক্ষক। প্রধান শিক্ষক এলাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেন। এ কারণে তার স্ত্রী পাপিয়া সুলতানা নিয়মিত স্কুলে আসেন না। তবে মাঝেমধ্যে আসেন এবং পুরো মাসের হাজিরা খাতায় সই করেন। এভাবে হাজিরা শিটে পুরো মাসের উপস্থিতি দেখিয়ে বেতন তোলেন। স্কুলে না আসলেও তার বেতন বন্ধ থাকে না। কিন্তু আমরা ভয়ে কিছু বলতে পারতাম না। তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি স্কুলে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তা নিয়ে সভাপতি এখন পর্যন্ত আসেননি। স্কুলে পকেট কমিটি করে এসব অনিয়ম করা হচ্ছে। এছাড়া বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষক মিঠুন কুমার, শাহনাজ সুলতানা ও মঞ্জুরুল আলমও একই অভিযোগ করেন।

স্থানীয় বাসিন্দা সোহেল রানা মিঠু বলেন, ম্যানেজিং কমিটি, প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষিকাকে আমরা চাই না। নতুন মুখ দেখতে চাই। তাহলে হয়তো স্কুলে শিক্ষার পরিবেশ ফিরে আসবে।

গত প্রায় পাঁচ বছর ধরে পরিবারসহ নওগাঁ শহরে বসবাস করছেন প্রধান শিক্ষক আবু সাদাত শামীম আহমেদ। এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে আবু সাদাত শামীম আহমেদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। স্কুলের বিষয়ে মন্তব্য জানতে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। আর পাপিয়া সুলতানার মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। এছাড়া তাকে খুদেবার্তা পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

এদিকে, বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আ স ম শফি মাহমুদের বিরুদ্ধেও সাধারণ শিক্ষক এবং এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত। প্রায় পাঁচ বছর থেকে স্কুলের সভাপতির দায়িত্বে আছেন তিনি। বর্তমান যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তার মেয়াদও প্রায় দেড় বছর। এ সময়ের মধ্যে তিনি কখনো স্কুলে যাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষিকার অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি স্কুলে যাননি। এমনকি স্কুলের কোনো বিষয়ে আলোচনাও করেন না।

এ বিষয়ে বিদ্যালয়টির সভাপতি শফি মাহমুদ বলেন, স্কুলের বিভিন্ন বিষয়ে নিয়মিত মিটিং করা হয়। সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা অসুস্থতার কারণে মাঝেমধ্যে স্কুলে যেতেন না। বিষয়টি সাধারণ শিক্ষকরাও মেনে নিয়েছেন। প্রধান শিক্ষক বেতন বিল তৈরি করেন আর আমি সই করি। তবে বেতন শিটে পুরো মাসের উপস্থিতি দেখিয়ে সই করা হয়। স্কুলে অনুপস্থিত থাকার পরও বেতন শিটে কীভাবে পুরো মাসের উপস্থিতি দেখিয়ে বেতন উত্তোলন করা হয়, এতে আপনার দায়ভার আছে কি না এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি এড়িয়ে যান।

এ বিষয়ে বদলগাছী সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শেখ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, আমরা জানি সহকারী প্রধান শিক্ষিকা পাপিয়া সুলতানা নিয়মিত স্কুলে যান। পরিদর্শনেও তার প্রমাণ রয়েছে। কারণ, হাজিরা খাতায় তার সই থাকায় আমরা বুঝবো তিনি নিয়মিত স্কুলে যান। এছাড়া বেতনের বিষয়টি প্রধান শিক্ষক ও সভাপতির সইয়ে হয়। আমরা শুধু দেখবো হাজিরা খাতায় উপস্থিত আছে কি না। যদি তিনি স্কুলে অনিয়মিত হন তাহলে তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় পরবর্তী  পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে জানান বদলগাছী সহকারী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার শেখ মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন।