স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে কী চিন্তা আ.লীগের

নতুন সরকার দায়িত্ব নিলেও বিরোধী দল কারা

প্রকাশিত: ১:২০ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৪, ২০২৪

ডেস্ক রিপোর্ট :

নতুন সরকার দায়িত্ব নিলেও বিরোধী দল কারা হবে, তা নিশ্চিত নয়। নির্বাচনে জয়ী ৬২ স্বতন্ত্র এমপি সংসদে কোন ভূমিকায় থাকবেন, সেটি এখনও স্পষ্ট হয়নি। অধিকাংশ স্বতন্ত্র এমপি সরকারে থাকতে চান। যারা জোট গঠন করে বিরোধী দল হওয়ার আভাস দিয়েছেন, তারাও রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায়। তবে স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা কী– তা অজানা। এদিকে জাতীয় পার্টিও (জাপা) ফের বিরোধী দলে বসতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। খবর সমকাল।

৭ জানুয়ারির নির্বাচনে স্বতন্ত্রদের এক-পঞ্চমাংশের কম মাত্র ১১ আসন পেয়ে ভরাডুবি হয়েছে জাপার। তবে দলটি আশায় আছে, স্বতন্ত্র জোট নয়, গত দুইবারের মতো তাদেরই বিরোধী দলের আসনে বসাবে সরকার। দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে বিরোধী দলের নেতা এবং জাপাকে প্রধান বিরোধী দল করার আশ্বাসে বিএনপিহীন নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল দলটি। এতে বন্ধুপ্রতিম একটি দেশের সম্পৃক্ততা রয়েছে; যারা আওয়ামী লীগকেও সর্বাত্মক সমর্থন দিয়েছে।

জাপার নবনির্বাচিত এক এমপি এ তথ্য জানিয়ে সমকালকে বলেন, এ কারণে হলেও জি এম কাদের বিরোধী দলের নেতা হবেন। জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, স্বতন্ত্ররা সংখ্যায় বেশি হলেও দল নয়। জাতীয় পার্টি দল হওয়ায় বিরোধী দল হবে।

আওয়ামী লীগের পদে থাকা স্বতন্ত্র এমপিরা জোট করে বিরোধী দল হতে পারে বলে বলে শপথের দিন আভাস দিয়েছিলেন কয়েকজন। টানা তৃতীয়বারের মতো ফরিদপুর-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী স্বতন্ত্র এমপি মজিবুর রহমান চৌধুরী নিক্সন বলেছিলেন, ‘এখনও বিরোধী দল গঠন হয়নি। আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা জোট অবশ্যই করব।’

তবে জোট গঠনের তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। অধিকাংশ এমপি বলছেন, সরকারে থাকতে চান। দলীয় সূত্রের খবর, অনেক এমপির শঙ্কা, বিরোধী দলে গেলে স্থানীয় রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হতে পারে। সরকারি দলের এমপির মতো সুযোগ-সুবিধা পাবেন না। বিরোধী দলে বসলে সরকারের কমবেশি সমালোচনা করতে হবে। এতে আগামী দিনে দলীয় মনোনয়ন পেতে সমস্যা হতে পারে। তবে কয়েকজন বিরোধী দলের আসনে বসার কথা বলেছেন।

বরগুনা-১ (সদর-আমতলী-তালতলী) আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গোলাম সরোয়ার টুকু। স্বতন্ত্র এমপিরা বিরোধী দলে থাকতে পারেন বলে মনে করছেন এই নেতা। তিনি বলেন, ‘সরকারের যে কোনো ভালো কাজের সমর্থন করব। জনস্বার্থবিরোধী হলে সর্বোচ্চ বিরোধিতা করা হবে। যেহেতু সংসদে আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না, তাই বিরোধী দলের এমপির মতো সংসদে থাকতে চাই। বাইরে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ে থাকবে।’

সরকারে থাকতে আগ্রহী বরিশাল-৪ (মেহেন্দীগঞ্জ-হিজলা) আসনের টানা তিনবারের এমপি পঙ্কজ নাথ। তিনি বলেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগ অনুমোদিত স্বতন্ত্র এমপি। আওয়ামী লীগের উন্নয়নের সহযোগী হিসেবে সংসদে কাজ করব।’ সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত জনস্বার্থবিরোধী হলে কী করবেন– প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘অবস্থা বুঝে তখন সিদ্ধান্ত হবে। যতটুকু পারমিট করে, ততটুকু বিরোধিতা করব।’

যশোর-৫ (মনিরামপুর) আসনের স্বতন্ত্র এমপি ইয়াকুব আলী বলেন, ‘জোট গঠনের ব্যাপারে এখনও কেউ যোগাযোগ করেনি। শপথ নিয়ে এলাকায় ফিরেছি। বঙ্গভবনে মন্ত্রিসভার শপথে ছিলাম। সেখানেও কারও সঙ্গে জোট গঠনের কথা হয়নি। স্বতন্ত্রদের নিয়ে জোট গঠনের ব্যাপারে ভাবছি না। প্রস্তাব এলে চিন্তাভাবনা করা যাবে।’

জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনুকে হারিয়ে আলোচনায় আসা কুষ্টিয়া-২ আসনের স্বতন্ত্র এমপি কামারুল আরেফিন বলেন, ‘স্বতন্ত্র এমপিদের নিয়ে জোট গঠনের সংবাদ পত্রিকায় পড়েছি। তবে কেউ আলোচনা করেনি।’ মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের এই সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘স্বতন্ত্র হিসেবে জিতলেও আওয়ামী লীগের বাইরে নই। তাই কেন্দ্রীয় নেতারা যেভাবে চাইবেন, সেভাবেই সিদ্ধান্ত নেব।’
ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের স্বতন্ত্র এমপি এ বি এম আনিছুজ্জামান বলেন, ‘আমি এখনও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। নেত্রী যেভাবে বলবেন, সেভাবেই এগিয়ে যাব।’

ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনের স্বতন্ত্র এমপি মাহমুদ হাসান সুমনও সরকারে থাকতে চান জানিয়ে বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কারও সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি। জাপার প্রার্থী ছিল প্রতিদ্বন্দ্বী। আওয়ামী লীগের সঙ্গে থেকে উন্নয়নে কাজ করে যাব।’

সরকারে থাকতে চান রাজশাহী-২ আসনে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশাকে হারানো স্বতন্ত্র এমপি শফিকুর রহমান বাদশা। তিনি বলেন, ‘বিশেষ প্রেক্ষাপটে নির্বাচন করতে হয়েছে কাঁচি প্রতীকে। বুকে বঙ্গবন্ধুকে ধারণা করি। নেত্রী যে নির্দেশনা দেবেন, তা-ই করব। নেত্রীর নির্দেশের বাইরে নই। সংবিধান বা কোথাও বলা নেই, আওয়ামী লীগ করা যাবে না।’
স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে শক্তিশালী বিরোধী দলের ভূমিকায় থাকতে চান নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের এমপি আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘স্বতন্ত্র এমপিরা যাঁর যাঁর পদ-পদবি অনুযায়ী নিজ নিজ এলাকায় আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ডে অংশ নেবেন।’

নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রানীনগর) আসনের স্বতন্ত্র এমপি অ্যাডভোকেট ওমর ফারুক জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণবিষয়ক সম্পাদক। তিনি বলেন, ‘আপাতত কোনো জোটে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। প্রধানমন্ত্রী যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তা মেনে চলব।’

রংপুর-৫ আসনে জয়ী স্বতন্ত্র এমপি জাকির হোসেন সরকার বলেন, ‘৩৭ বছর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। অন্য কোনো জোট নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে থাকতে চাই।’ নীলফামারী-৩ আসনে বিজয়ী স্বতন্ত্র এমপি সাদ্দাম হোসেন পাভেলও স্বতন্ত্র জোটে নয়, আওয়ামী লীগে থাকতে চান।

হবিগঞ্জ-১ (নবীগঞ্জ-বাহুবল) আসনের স্বতন্ত্র এমপি আমাতুল কিবরিয়া চৌধুরী কেয়া বলেন, ‘স্বতন্ত্র জোট আমার কাছে একটি অসহ্য ব্যাপার। আমি তা চাই না। আমি আওয়ামী লীগের। স্বতন্ত্র এমপি হয়েছি বলে বিরোধী দল, এটি মেনে নিতে পারছি না।’

চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) আসনের স্বতন্ত্র এমপি আবদুচ ছালাম বলেন, ‘শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দিলে স্বতন্ত্র জোটে যাব। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে নই।’ একই কথা বলেছেন চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের স্বতন্ত্র এমপি এম এ মোতালেব।

জাপার পাঁচ গুণের বেশি আসনে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। দল না হলেও স্বতন্ত্র এমপিরা জোট বেঁধে সংখ্যায় বেশি হলে বিরোধী দল হতে পারবেন কিনা– এ বিষয়ে স্পষ্ট করে বলা নেই সংবিধান, আইন ও সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে। আইন ও বিধিতে বলা হয়েছে, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনামতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চ সংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসংঘের নেতা।’

সংসদীয় দল বা অধিসংঘ ন্যূনতম কতজন এমপি নিয়ে হতে হবে, তা বলা নেই বিধিতে। ১৯৮৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনেও জাসদ (রব) নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বিরোধী দলের (কপ) চেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। কপ পেয়েছিল ১৯ আসন। স্বতন্ত্র এমপি ছিলেন ২৫ জন। তবে স্পিকার কপকে সরকারের বিরোধিতাকারী বৃহত্তম অধিসংঘের মর্যাদা দেন। জাসদ (সিরাজ), ফ্রিডম পার্টি ও স্বতন্ত্র ৯ এমপি আ স ম আবদুর রবকে নেতা মেনে আবেদন করেন। তাঁকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন স্পিকার।

এবার জয়ী ৬২ স্বতন্ত্র এমপির ৫৯ জন আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পৃক্ত। দু’জন বাদে সবার দলীয় পদপদবি রয়েছে। নৌকা না পেয়ে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। জাপার সঙ্গে সমঝোতার কারণে গাইবান্ধা-১ আসনের নৌকার প্রার্থী আফরোজা বারী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় তাঁর মেয়ে আবদুল্লাহ নাহিদ নিগার স্বতন্ত্র প্রার্থী হন। আফরোজা বারী সুন্দরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি; নাহিদ নিগারের দলীয় পদ নেই।
পিরোজপুর-৩ আসনে জয়ী শামীম শাহনেওয়াজেরও আওয়ামী লীগে পদ নেই। তাঁর ভাই উপজেলার সাধারণ সম্পাদক আশরাফুর রহমান মনোনয়ন পেয়েছিলেন। জাপাকে আসন ছাড়ায় নৌকা হারান। শামীম শাহনেওয়াজ স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে এমপি হয়েছেন।

নীলফামারী-৪ আসনে জয়ী হয়েছেন জেলা জাপার সহসভাপতি পদ থেকে বহিষ্কার হওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থী সিদ্দিকুল আলম। সিলেট-৫ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জয়ী হয়েছেন ফুলতলীর হুজুরের ছেলে মোহাম্মদ হুছামউদ্দিন চৌধুরী। তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি না করলেও সরকারের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। ‘কেন্দ্রীয় নির্দেশে’ স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহু নেতা তাঁর পক্ষে নৌকার বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রচার চালান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১ আসনে জয়ী হয়েছেন নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি থেকে বহিষ্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এ কে একরামুজ্জামান।

অনিবন্ধিত দল আঞ্জুমানে আল ইসলাহর সভাপতি হুছামুদ্দিন চৌধুরী বলেন, স্বতন্ত্র এমপিদের স্বতন্ত্র থাকাই ভালো। তবে এ নিয়ে আলোচনা ও চিন্তার বিষয় রয়েছে। কার মত কী, কে কী চান– তা পর্যালোচনা না করে কিছু করা ঠিক হবে না।

প্রথম সাতটি সংসদে স্বতন্ত্র এমপির অধিকাংশই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সংসদীয় দলে যোগ দিয়েছিলেন। তবে ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের পর এ নজির নেই। নবম সংসদের তিন স্বতন্ত্র এমপি পুরো মেয়াদে স্বতন্ত্র হিসেবেই গণ্য হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয়ী ১৬ স্বতন্ত্র এমপি হাজী সেলিমের নেতৃত্বে জোট করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের পদে থাকলেও দলটির সংসদীয় দলে যোগ দিতে পারেননি।