ডেস্ক রিপোর্ট :
গত ৭ জানুয়ারি দেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়লাভ করেছেন। ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ৬২ জন স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে ৫৮টিই আওয়ামী লীগ বা তার সহযোগী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। এদের অনেকেই দলের দায়িত্বশীল পদেও রয়েছেন। স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত এসব এমপিদের বড় অংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে থাকতে চান। তারা দলে যোগদান করে দলীয় এমপি হিসেবেই পরিচিত হতে চান। তবে স্বতন্ত্র এমপিদের রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অতীতে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত এমপিরা তাদের ইচ্ছামতো যে কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দেওয়ার সুযোগ থাকলেও রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পদ্ধতি চালু ও সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনের পরে এক্ষেত্রে কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরাও এ বিষয়ে দুধরনের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাদের একটি অংশ যোগ দিতে আইনে বাধা নেই বলে দাবি করলেও অন্যরা বলছেন বিষয়টি আইনে ‘স্পষ্ট করা হয়নি’।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ও সংবিধান অনুযায়ী বর্তমানে সেই সুযোগ রয়েছে কি না, তাও স্পষ্ট নয়। অতীতের সংসদগুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালের আগের সংসদগুলোতে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত প্রার্থীদের অনেকেই রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়ে সেই দলের সংসদ সদস্য হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। তবে ২০০৯ সালের পর থেকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিতদের কোনও দলে যোগ দিতে দেখা যায়নি। বিএনপির সাবেক এমপি ফজলুল আজিম ২০০৮ সালে দলের মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্রভাবে ভোট করে জয়লাভ করেন। বিএনপির সাবেক এই নেতা অষ্টম জাতীয় সংসদের স্বতন্ত্র এমপি হিসেবেই তার ৫ বছর কাটিয়েছেন। এর ধারাবাহিকতায় দশম ও একাদশ সংসদের স্বতন্ত্র এমপিরাও স্বতন্ত্র এমপি হিসেবেই ভূমিকা রেখেছেন।
অবশ্য দশম সংসদে নির্বাচিত স্বতন্ত্র ১১ জন এমপি ২০১৭ মে মাসে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। তারা দলটির সংসদীয় দলের সভায়ও যোগ দিয়েছিলেন। বিষয়টি ওই সময় সংসদীয় দলের সেক্রেটারি নূর-ই-আলম চৌধুরী গণমাধ্যমের কাছে স্বীকারও করেন। বিষয়টি নিয়ে তারা স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে কথাও বলবেন বলে জানিয়েছিলেন। তবে পরে বিষয়টি নিয়ে কেউ খোলাসা করেননি।
ওই সংসদের বাকি মেয়াদে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সব সদস্যই সংসদের কাছে স্বতন্ত্র এমপি হিসেবেই দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই ১১ স্বতন্ত্র এমপির মধ্যে প্রায় সবাই একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছিলেন। নির্বাচিত হয়েই আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে একাদশ সংসদে ভূমিকা রেখেছিলেন। অবশ্য এর আগেই ওই স্বতন্ত্র এমপিদের অনুকূলে নির্বাচিত সংরক্ষিত আসনের এমপিরা আওয়ামী লীগের এমপি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, স্বতন্ত্র এমপিরা সংরক্ষিত আসনের নির্বাচনের আগেই তাদের আসনগুলোর অনুকূলে প্রাপ্য সংরক্ষিত আসনের দুজন মহিলা এমপির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায়িত্ব সংসদ নেতা শেখ হাসিনার ওপর অর্পণ করেছিলেন।
স্বতন্ত্র এমপিদের রাজনৈতিক দলে যোগদানের বাধার কথা উল্লেখ করে সংশ্লিষ্টদের একটি অংশ বলেছেন- গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে দুই ধরনের প্রার্থীর কথা স্পষ্ট বলা হয়েছে। বলা হয়েছে (ধারা-১২ (১)(ক)- নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থী। এছাড়া রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনে শর্তের ক্ষেত্রে আরপিও-তে [৯০ (খ) (২)] ধারায় বলা হয়েছে- স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচিত কোনও সদস্য পরবর্তীকালে কোনও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলে যোগদান করলে তার সদস্য পদ যোগদানকারী দল কর্তৃক আহরিত হয়েছে মর্মে গণ্য হবে না। এছাড়া আরপিও ১২ ধারায় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার ১ শতাংশ ভোটারের বাধ্যবাধকতার বিষয়ের কথাও জানান সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কথা উল্লেখ করে তারা বলেছেন, কোনও স্বতন্ত্র প্রার্থী কোনও রাজনৈতিক দলে যোগদান করলেও ওই দলের মনোনীত বলে গণ্য হবে বলে আগে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বিধান ছিল। কিন্তু ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে ওই ধারাটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থায় বিষয়টি কী হবে তা স্পষ্ট নয়।
অপরদিকে জাতীয় সংসদ (সংরক্ষিত মহিলা আসন) আইন- ২০০৪ এ স্বতন্ত্র/নির্দলীয় সদস্যদের রাজনৈতিক দলে যোগদানের কথা বলা হয়েছে। আইনের ৩ (৩) ধারায় বলা হয়েছে- কোন নির্দলীয় সদস্য কোনও রাজনৈতিক দল বা জোটে যোগদান করলে নির্বাচন কমিশন যোগদানকারী সদস্যকে সংশ্লিষ্ট দল বা জোটের মনোনয়নে নির্বাচিত সদস্য হিসেবে গণ্য করে তার নাম উক্ত দল বা জোটের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব সংসদ ও নির্বাচন আইন বিশেষজ্ঞ এ কে এম মোহাম্মদ হোসেন বলেন, ‘কোনও দলে যোগ দিতে বাধা নেই। দলে যোগ দিলে তিনি আর স্বতন্ত্র এমপি হিসেবে থাকতে পারবেন না। এক্ষেত্রে ৭০ অনুচ্ছেদ তার ওপর বর্তাবে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম বলেন, ‘স্বতন্ত্র প্রার্থীদের রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসেবে যুক্ত হতে আইনি কোনও বাধা নেই। তারা দলে যোগ দিতে পারবেন।’
এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন প্রশ্নে এই আইনজীবী বলেন, ‘এক শতাংশ ভোটারের সমর্থন কোনও ম্যাটার করে না। কারণ এটা ভোট নয়। প্রার্থী হওয়ার প্রি-কোয়ালিফিকেশন। তিনি জনগণের ম্যান্ডেট পেয়ে জয়ী হয়েছেন। জয়ী হওয়ার পর তার নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে।’
সাবেক নির্বাচন কমিশনার কবিতা খানমও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘দলীয়ভাবে নির্বাচিতদের অন্য কোনও দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। কিন্তু স্বতন্ত্র প্রার্থীরা চাইলে যুক্ত হতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে আইনি কোনও বাধা আছে বলে আমি মনে করি না।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সচিবালয়ের যুগ্ম সচিব নাজমুল হক বলেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা কোনও রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে ওই দলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে গণ্য হবেন বলে আগে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে বিধান ছিল। কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনীতে ওই বিধানটি তুলে দেওয়া হয়েছে। যার কারণে এটা পারবে এমনটাও বলা নেই। আর পারবেন না এমনটাও বলা নেই। বিষয়টি উহ্য রয়েছে। কাজেই এটা স্পষ্ট নয়। তিনি মনে করেন, কোনও বিধান বাদ দেওয়ার অর্থই হলো— সেখানে যে সুযোগ ছিল, সেই সুযোগটিও তুলে দেওয়া।
এখানে উল্লেখ্য ৭০ অনুচ্ছেদে বর্তমানে কেবল রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থীর কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে— কোনও নির্বাচনে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি- (ক) উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন, অথবা (খ) সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাহার আসন শূন্য হইবে, তবে তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনও নির্বাচনে সংসদ-সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।
নির্বাচনি আইন নিয়ে দীর্ঘদিন চর্চা করছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট রিয়াজুল কবীর কাওছার। এ বিষয়টির ব্যাখ্যা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘স্বতন্ত্র এমপিদের কোনও রাজনৈতিক দলের যোগ দিয়ে তাদের প্রার্থী হিসেবে পরিচিত হওয়ার পথ ২০০৮ সালে বন্ধ হয়ে গেছে।’
তিনি জানান, আরপিও অনুযায়ী প্রার্থী দুই ধরনের স্বতন্ত্র এবং রাজনৈতিক দল মনোনীত। কাজেই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনোভাবেই দলে যোগদান বা দলীয় মনোনীত প্রার্থী হওয়ার সুযোগ নেই।
২০১৭ সালে যে ১১ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছিল তখন সংসদের চিফ হুইপ ছিলেন আওয়ামী লীগ দলীয় সিনিয়র এমপি আ স ম ফিরোজ। তার কাছে ওই বিষয়টি জানতে চাইলে বলেন, ঘটনাটি তো কয়েকবছর আগের। প্রকৃতপক্ষে কী হয়েছিল, এই মুহূর্তে তা আমার স্মরণে নেই। তবে আমার মতে স্বতন্ত্রদের কোনও দলেই যোগ না দেওয়াই ভালো। তারা নিজেদের মতো করে সংসদে ভূমিকা রাখতে পারে। এতে সংসদ বেশি কার্যকর হবে।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী একাধিক স্বতন্ত্র এমপির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তারা সংসদে সরকারি দল আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে সরকারি দলের আসনেই বসতে চান। যে কোনও প্রক্রিয়ায় তারা আওয়ামী লীগের সাথেই থাকতে চান। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচিত পঙ্কজ দেবনাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমি আগে আওয়ামী লীগের এমপি ছিলাম। এবার স্বতন্ত্রভাবে এলেও আওয়ামী লীগের সাথেই আছি, সঙ্গেই থাকতে চাই।’
এখানে উল্লেখ্য যে, স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দলে যোগদানের বিষয়টি নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে তেমনি জোটবদ্ধ হয়ে তাদের বিরোধী দল হওয়ার সুযোগের বিষয়টিও স্পষ্ট নয়। দেশের সংবিধান বা কোন আইন-বিধিতে বিরোধী দল ইস্যুতে কোন নির্দেশনা নেই, কেবল সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে ‘বিরোধী দলীয় নেতা’ কথাটি উল্লেখ রয়েছে। কার্যপ্রণালি বিধির ২(১)(ট) ধারা অনুযায়ী, ‘বিরোধী দলের নেতা অর্থ স্পিকারের বিবেচনা মতে যে সংসদ সদস্য সংসদে সরকারি দলের বিরোধিতাকারী সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য লইয়া গঠিত ক্ষেত্রমত দল বা অধিসংঘের নেতা।’
অপরদিকে সংবিধানের ১৫২ নম্বর ধারায় রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় বলে দেওয়া হয়েছে। এতে ‘রাজনৈতিক দল’ বলতে বলা হয়েছে— ‘এমন একটি অধিসংঘ বা ব্যক্তি সমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসংঘ বা ব্যক্তি সমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোনও নামে কার্য করেন এবং কোনও রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোনও রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসংঘ হইতে পৃথক কোনও অধিসংঘ হিসেবে নিজদিগকে প্রকাশ করে’। ফলে অধিসংঘ বলতে রাজনৈতিক দলই বুঝিয়েছে নাকি ব্যক্তি সমষ্টিকে বোঝায়, তার স্পষ্ট ব্যাখ্যা প্রয়োজন।