
সেলিনা আক্তার:
পতিত শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে যে তিমিরে ছিল, অন্তর্র্বতী সরকারের সাত মাস পার হওয়ার পরও সেখানেই পড়ে আছে দেশের শেয়ারবাজার। আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর বিনিয়োগকারী ও বাজার অংশীজনের মধ্যে শেয়ারবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তনের বড় প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে তা হতাশায় রূপ নিয়েছে।
হতাশার অন্যতম কারণ, আগের অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিচার এখনও দৃশ্যমান নয়। অতীতের ধারায় কারসাজি চক্রকে শুধু জরিমানাই করে যাচ্ছে বিএসইসি। ফলে শেয়ার কারসাজি বন্ধ হয়নি। বড় ধরনের সংস্কারের কথা বলা হলেও এ-সংক্রান্ত কমিটিই জানে না, কবে সংস্কার প্রস্তাব দেবে। এদিকে দর পতনে পুঁজি হারিয়ে হাজার হাজার বিনিয়োগকারী বাজার ছাড়ছে। আইপিও বাজারও ‘গড়ের মাঠ’। পরিস্থিতি উত্তরণে যেসব বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে কাজ করার কথা, তাদের সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার সম্পর্ক ভালো নয়।
পরিবর্তনের সূচনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে চালকের আসনে বসা বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নিজেই এখন গভীর সংকটে। চেয়ারম্যানসহ কমিশনারদের পদত্যাগ চেয়ে গত বুধবার টানা চার ঘণ্টা অবরুদ্ধ রাখা ও অশোভন আচরণ করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়েছেন কিছু কর্মকর্তা। বৃহস্পতিবার নজিরবিহীন সর্বাত্মক কর্মবিরতিও পালন করেন। এ ঘটনায় দুই নির্বাহী পরিচালকসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা হয়েছে। ওই কর্মকর্তারা গ্রেপ্তার আতঙ্কে গতকাল অফিসে আসেননি। অস্বস্তি ও চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে সংস্থার কর্মকর্তাদের মধ্যে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিএসইসির বর্তমান অবস্থাই শেয়ারবাজারের প্রকৃত বেহাল দশাই ফুটে উঠেছে। অনেকের মত, অতীতের বেশ কয়েকটি কমিশন দুর্নীতিগ্রস্ত ছিল। বর্তমান কমিশনের সততা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও গত সাত মাসের কার্যক্রম প্রমাণ করেছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে তাদের দক্ষতায় ব্যাপক ঘাটতি আছে।
সাত মাস পর শেয়ারবাজার কোথায়
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরদিন থেকে শেয়ারবাজারে ব্যাপক উত্থান সৃষ্টি হয়েছিল। টানা চার দিন শেয়ারদরে উত্থান হয়। এতে সূচক বেড়েছিল ৭৮৬ পয়েন্ট। এক দিনে শেয়ার কেনাবেচা ২ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল। নতুন করে মুনাফার আশায় নতুন করে অনেকে বিও অ্যাকাউন্ট খুলে বিনিয়োগ শুরু করেছিলেন। সাত মাস পর চিত্রটা উল্টো। এ সময়ে অনেকের ২০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশ পুঁজি নেই। প্রায় ৭০ শতাংশ দর হারিয়েছে। দৈনিক গড়ে ৫০৫ কোটি টাকার শেয়ার কেনাবেচা হয়েছে, যা গত বছরের সময়ে ছিল ৬৭৯ কোটি টাকা।
এরই মধ্যে সংকটে পড়া এস আলম গ্রুপের কোম্পানি এস আলম কোল্ড রোল্ড স্টিলের শেয়ারদর মাত্র তিন সপ্তাহে আড়াই গুণ বেড়ে ২৫ টাকা ছাড়ায়। বেক্সিমকো গ্রুপের শাইনপুকুর সিরামিক্স কোম্পানির শেয়ারও একই সময়ে দ্বিগুণ হয়। বহু বছর বন্ধ খুলনা প্রিন্টিংয়ের শেয়ারদর দেড় মাসে ৫ গুণ হয়েছিল। এসব দরবৃদ্ধি স্বাভাবিক ছিল না, নেপথ্যে ছিল কারসাজি, যা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বর্তমান কমিশন।
সিডিবিএল প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত সাত মাসে নতুন ৪৫ হাজার ১১৯টি বিও অ্যাকাউন্ট খোলা হলেও সক্রিয় অ্যাকাউন্ট বেড়েছে মাত্র ১৮ হাজার ৯৭৪টি। এ সময়ে ৩২ হাজার ৪২৫টি অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি শেয়ার শূন্য হয়েছে। বিও অ্যাকাউন্ট খোলার পরও ছয় হাজারের বেশি অ্যাকাউন্টে কোনো শেয়ার কেনা হয়নি। বিপুলসংখ্যক বিনিয়োগকারী আস্থা হারিয়ে বাজার ছেড়েছেন। আবার যারা বিনিয়োগ করবেন বলে অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, তাদেরও উল্লেখযোগ্য অংশ একই কারণে বিনিয়োগের খাতাই খোলেননি।
হাসিনা সরকারের পতনের পর বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতও আত্মগোপনে যান। অন্তর্র্বতী সরকার সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে চেয়ারম্যান করে কমিশনের নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। তবে নতুন নেতৃত্ব বাজারে আশাব্যঞ্জক কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। সব অংশীজনকে নিয়ে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ তাদের নেই। ফলে অংশীজনের সঙ্গে কমিশনের দূরত্ব বেড়েছে। অংশীজনের অভিযোগ, কমিশন চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা কারও সঙ্গে কথা বলতে চান না। তারা সবাইকে অপরাধী ভাবেন। বাজারের এ ক্রান্তিকালে যেখানে অতীতের ভুল, অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করার পাশাপাশি বিনিয়োগ অনাস্থা কাটিয়ে ওঠা জরুরি তখন বিএসইসির চেয়ারম্যান ‘একলা চলো’ নীতি নিয়ে চলছেন।
অনিয়মের গুটিকয়েক ঘটনার তদন্ত হচ্ছে
অসংখ্য অনিয়ম ও কারসাজির ঘটনা থেকে গত সেপ্টেম্বরে মাত্র ১২টি ঘটনা বাছাই করে তদন্ত করতে চার সদস্যের কমিটি করে বিএসইসি। এ বিষয়ে গত সেপ্টেম্বরে সংবাদ সম্মেলনে বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেছিলেন, তদন্তের বিষয় এই ১২টিতে সীমাবদ্ধ থাকবে না, কমিটিও আরও হবে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর তা জনসম্মুখে প্রকাশ এবং দ্রুততম সময়ে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। তবে ছয় মাস পার হওয়ার পর জানা যাচ্ছে, তদন্ত কমিটি এখনও ওই ১২টি বিষয়ে সীমাবদ্ধ আছে। এর মধ্যে আটটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে তদন্ত কমিটি। কিছুদিনের মধ্যে আরও তিনটি ইস্যুতে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে। গত নভেম্বরে একাধিক তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে অন্তত তিন মাস সময় বিলম্ব করেছে কমিশন। এ ছাড়া আরও সুনির্দিষ্ট অনিয়মের অভিযোগ তদন্তে নতুন কমিটি গঠন বা আরও তদন্তের বিষয় যুক্ত করার বিষয়ে কোনো ঘোষণা নেই।
তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য ইয়াওয়ার সায়ীদ সমকালকে বলেন, অনিয়মের বিষয়ে যাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে, তাদের বিষয়ে প্রতিবেদন দিয়েছেন তারা। সাবেক দুই কমিশনের চেয়ারম্যান, কমিশনার ছাড়াও কমিশন কর্মকর্তাদের দায় চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন। তাদের শুনানিতে ডেকে বক্তব্য এদের অনেকের বক্তব্য নিয়েছেন। কিছু বিষয়ে অধিকতর তদন্তের সুপারিশ ছাড়াও ভবিষ্যতে এমন অনিয়ম ও কারসাজি প্রতিরোধে নীতি সুপারিশও করেছেন।
সংস্কার ঘোষণা এখনও আশ্বাসে
শেয়ারবাজার সংস্কারে গত অক্টোবরে পাঁচ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বিএসইসি। তবে পাঁচ মাস পার হওয়ার পর কবে পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ দেবে, তা কমিটির সদস্যরাই নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না। এখন পর্যন্ত কমিটি মার্জিন ঋণ ও মিউচুয়াল ফান্ড ইস্যুতে কিছু সুপারিশ জমা দিয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউসের কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, পাঁচ মাসে সংস্কার কমিটির এমন সুপারিশ হাস্যকর। তারা যে সুপারিশ করেছেন, তা বাজার সংস্কারের ছোট্ট অংশ মাত্র। বাজারের কাঠামোগত সমস্যা আছে। বিভিন্ন সংস্থা এ প্রতিষ্ঠানের কাঠামো, এগুলোর যোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্ব নির্বাচন ও দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে কিনা, তা নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। কারসাজি বড় সমস্যা। এসব বিষয়ে বিনিয়োগকারীরা শুধু সংস্কার সুপারিশ নয়, সফল বাস্তবায়ন দেখতে চায়।
কমিটির সদস্য ও ডিএসইর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাজেদুর রহমান সমকালকে বলেন, সংস্কার কমিটির সদস্যরা প্রত্যেকেই নিজস্ব কাজে ব্যস্ত। কেউ পুরোপুরি সময় দিতে পারছেন না। কমিশন জুনের মধ্যে সুপারিশ চাইছে। বর্তমান কমিটি দিয়ে আদৌ সম্ভব কিনা, তিনি বুঝতে পারছেন না।
নিয়ন্ত্রক সংস্থাতেই অচলাবস্থা
শেয়ারবাজারে সমস্যার কোনো শেষ না থাকলেও এখন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থায় চলমান অচলাবস্থা। কয়েকদিন ধরে পুরো কমিশনের পদত্যাগ দাবি করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাদের অভিযোগ, আইনের মধ্যে কাজ করার কথা বললেও বাস্তবে কমিশন আইনের বাইরে কাজ করতে চায়। আনুষ্ঠানিক নোট না দিয়ে মৌখিক নির্দেশ দেয়। তারা কমিশনের প্রশাসনিক কাজ বোঝেন না। কর্মকর্তারা পরামর্শ দিতে গেলে দুর্ব্যবহার করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক কর্মকর্তা সমকালকে জানান, কমিশনের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের বিরুদ্ধে বেশির ভাগ কর্মকর্তার ক্ষোভ রয়েছে। তারা কর্মকর্তাদের প্রায় সবাইকে দুর্নীতিবাজ বলে মনে করেন, যা আদতে সত্য নয়। কমিশনে কারও বিষয়ে সন্দেহ থাকলে তাদের বিরুদ্ধে চাকরি বিধি মেনে কমিশন তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পারে। তা না করে কটূক্তি করেন। কমিশনের কোনো কর্মকর্তাই স্বচ্ছন্দে কাজ করতে পারছেন না।
কমিশনের বক্তব্য
সার্বিক বিষয়ে মতামত জানতে বিএসইসির চেয়ারম্যান খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে কয়েক দফায় ফোন করা হলেও তিনি সাড়া দেননি। গত বৃহস্পতিবার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, বিগত কমিশনের সময়ে যারা জড়িত ছিল, তারা এ অচলাবস্থা সৃষ্টির নেপথ্যে থাকতে পারেন। কর্মকর্তাদের আনা অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন।
সমাধান চায় সব পক্ষ
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, বর্তমান কমিশনের সততা ও সদিচ্ছা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। অতীতে লম্বা সময়ের অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার সুরাহা একদিনে সমাধান সম্ভব নয়। ডিএসইর চেয়ারম্যান বলেন, অতীতে অনিয়মে যারা জড়িত ছিল, তারা এখনও বহাল। ফলে বড় ধরনের কিছু করতে গেলে স্বভাবতই বাধা আসছে। এ জন্য সময় দিতে হবে। এটাও মানতে হবে, সংস্কারে বেশি সময় লাগলে, বিনিয়োগকারীরা তার জন্য বসে থাকবেন না। এতে অনাস্থা বাড়বে।
মমিনুল ইসলাম বলেন, যারা দুর্নীতিগ্রস্ত, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও প্রমাণ সাপেক্ষে আইনি প্রক্রিয়ায় অবশ্যই বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিরপরাধ কেউ হয়রানি হলে বাজারে ভুল বার্তা যাবে, মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তাছাড়া বাজারের সব অংশীজনকে সঙ্গে নিয়ে সংস্কার করতে হবে বলে মত দেন তিনি।
শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিনিয়োগ সংস্থা আইসিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, একটা ভঙ্গুর রাষ্ট্র ব্যবস্থা থেকে উত্তরণে কিছু সময় দরকার। শেয়ারবাজারে অতীতের কমিশনগুলোর অনিয়ম যে ক্ষত তৈরি করেছে, তাও রাতারাতি সেরে যাবে আশা করা ঠিক নয়। গত কয়েক মাসে শেয়ারবাজারে যে অস্থিরতা আছে, এর কারণ সামষ্টিক অর্থনীতির বেহাল দশা। আশার কথা, অবস্থা এখন ভালোর দিকে। এর সুফল শেয়ারবাজারে এখনও নেই। এর বড় কারণ সুদের হার। সুদের হার কমলে বাজার স্বাভাবিক ধারায় যাবে। এখন দরকার ভালো নেতৃত্ব দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরানো এবং বাজারকে এগিয়ে নেওয়া।