১৮ মিনিটের যুগান্তকারী ভাষণই বিশ্বের মানচিত্রে সৃষ্টি করে নতুন একটি দেশ
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
৭ই মার্চ কেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না, জানতে চেয়েছিলেন ডেভিড ফ্রস্ট। জবাবে বঙ্গবন্ধু তাঁকে জানান, ‘মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে, পাল্টা আঘাত করা ছাড়া আমাদের আর কোনো বিকল্প নেই, দুনিয়াকে এমন কিছু বলার সুযোগ আমি ওদের দিতে চাইনি। আমি চাইছিলাম, আগে তারা আঘাত করুক।’ তাঁর এই স্ট্র্যাটেজি যে কতটা ফলপ্রসূ হয়েছিল তার প্রমাণ বাংলাদেশ। ১৮ মিনিটের যুগান্তকারী এই ভাষণই বিশ্বের মানচিত্রে সৃষ্টি করে নতুন একটি দেশ
রেসকোর্স ময়দান। সকাল থেকেই দলে দলে লোক ছুটছে ময়দানের দিকে। গ্রামবাংলা থেকে মানুষ রওনা দিয়েছে ঢাকার পথে। সকাল ১০টা-১১টার মধ্যেই আমরা শুনতে পারলাম, ময়দানে লোকের আনাগোনা শুরু হয়েছে। একটা মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, খুবই সাদাসিধে মঞ্চ। মাথার ওপর কোনো চাঁদোয়া নেই, শুধু একটা খোলা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। পশ্চিম দিকে মুখ করে মঞ্চটা তৈরি। পূর্ব দিকে রাস্তার পাশ থেকে একটি সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। মাঠজুড়ে বাঁশ পুঁতে পুঁতে মাইকের হর্ন লাগানো হচ্ছে। যতই মানুষ বাড়ছে, ততই হর্ন লাগানো হচ্ছে। মাইক যাঁরা লাগাচ্ছেন, তাঁরাও যেন হিমশিম খাচ্ছেন, কোনো কূলকিনারা পাচ্ছেন না। কত মানুষ হবে? মানুষ বাড়ছে আর তাঁরা তার টানিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ভলান্টিয়াররা খুবই তৎপর। মানুষের মাঝে প্রচণ্ড এক আকাঙ্ক্ষা, শোনার অপেক্ষা, কী কথা শোনাবেন নেতা। যাঁরা আসছেন, তাঁদের হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা ও লগি। তাঁদের মুখে-চোখে একই আকাঙ্ক্ষা—স্বাধীনতা। দীর্ঘ ২৩ বছরের শোষণ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এ মানুষগুলোর মুখে-চোখে। এ ময়দানে শরিক হয়েছে সর্বস্তরের মানুষ—নারী-পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, ছাত্র-শিক্ষক, কিষান-কিষানি, জেলে-কামার, কুমার-তাঁতি, রিকশাওয়ালা, নৌকার মাঝি, শ্রমিক। কোনো সম্প্রদায়ের মানুষ ঘরে নেই।
ঢাকা শহরে এত মানুষ কোথা থেকে এলো? এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, বিস্ময়কর চিত্র।
ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ি। মিরপুর রোড থেকে প্রবেশ করলে, অর্থাৎ পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে গেলে পঞ্চম বাড়িটি। এ বাড়িতেই বাস করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে বাড়িটিও লোকে লোকারণ্য। সড়কে মানুষের ঢল। লেকের পাড়ে সড়ক, তার পাশে বাসা। ছোট বাসা। নিচতলা থেকে দোতলা পর্যন্ত নেতা-কর্মীদের আনাগোনা। এ ছাড়া শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, আইনজীবী, ছাত্রনেতারা একের পর এক আসছেন। সবাই ব্যস্ত নেতা শেখ মুজিব আজ কী বক্তব্য দেবেন, তা জানার জন্য। সবাই যাঁর যাঁর মতামত দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে লেখা কাগজ দিচ্ছেন। আজকের এই সমাবেশে কী ভাষণ দেওয়া উচিত, তা নিয়েও আলোচনা করছেন। কোনো কোনো ছাত্রনেতা এ কথাও বলছেন, ‘আজকেই সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন—আমরা প্রস্তুত।’ আরো বলছেন, ‘এটা যদি না বলেন মানুষ হতাশ হয়ে যাবে।’খুবই উত্তেজিত তাঁরা।
রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের মন্তব্য দিচ্ছেন। লিখিত কাগজ এত পরিমাণে জমে গেল যে প্রায় বস্তা ভরে যাবে।
নিচের অফিসঘর থেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ওপরে দোতলায় এলেন। মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা এক কাপ চা লেবুর দুই ফোঁটা রস দিয়ে আব্বার হাতে তুলে দিলেন। বললেন, ‘তুমি এখানে বসো, চা খাও, খাবার প্রস্তুত করছি।’ সেখানে আমাদের অনেক নেতা উঠে এসেছেন, আত্মীয়-স্বজন আছেন, ছাত্রনেতারাও আসছেন-যাচ্ছেন।
সময় প্রায় হয়ে এলো। মা টেবিলে খাবার দিলেন। বেশি কিছু আহামরি খাবার নয়, বাঙালির সাধারণ যে খাবার—ভর্তা, সবজি, ভাজা মাছ, মাছের ঝোল।
তিনি খেলেন। সঙ্গে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরাও খেলেন। সঙ্গে বক্তৃতা নিয়ে আলোচনা চলছেই। খাওয়া শেষ হলে মা সবাইকে বললেন, ‘আপনারা এখন মাঠে চলে যান।’
আব্বাকে মা ঘরে যেতে বললেন। পাশের ঘরটা শোয়ার ঘর। আমি আর আব্বা ঘরে গেলে মা বললেন, ‘তুমি একটু বিশ্রাম নাও।’ আব্বা বিছানায় শুয়ে পড়লেন। আমি আব্বার মাথার কাছে বসে আব্বার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম। এটা আমার সব সময়ের অভ্যাস। মা একটা মোড়া টেনে বসলেন। হাতে পানের বাটা। পান বানিয়ে আব্বার হাতে দিলেন। তারপর তিনি বললেন, ‘দেখো, তুমি সারাটা জীবন এ দেশের মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছ, দেশের মানুষের জন্য কী করতে হবে, তা সবার চেয়ে তুমিই ভালো জানো। আজকে যে মানুষ এসেছে, তারা তোমার কথাই শুনতে এসেছে। তোমার কারো কথা শোনার প্রয়োজন নেই, তোমার মনে যে কথা আছে তুমি সেই কথাই বলবে। আর সেই কথাই সঠিক কথা হবে। অন্য কারো কথায় তুমি কান দেবে না।’
আব্বা কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলেন।
সভায় যাওয়ার সময় আগত। তিনি প্রস্তুত হয়ে রওনা হলেন।
আমরাও অন্য একটা গাড়িতে মাঠে পৌঁছলাম। মা বাড়িতেই থাকলেন। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছে তিনি দৃপ্ত পায়ে মঞ্চে উঠলেন। একনজর তাকালেন উত্তাল জনসমুদ্রের দিকে। তারপর বজ্রকণ্ঠে গর্জে উঠলেন : ‘ভায়েরা আমার…’
এ ঐতিহাসিক ভাষণ যখন তিনি দেন, তাঁর হাতে কোনো কাগজ ছিল না, ছিল না কোনো নোট। চোখের চশমাটা খুলে টেবিলে রেখে তিনি ভাষণটা দিলেন, ঠিক যে কথা তাঁর মনে এসেছিল, সে কথাগুলোই তিনি বলেছিলেন। বাংল