পুরো দেশকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণার পর মাঠ প্রশাসনের তৎপরতা বাড়ছে। তবে সংক্রমণ ছড়ানোর কেন্দ্রস্থল ঢাকা (একাংশ), নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে যাওয়া ব্যক্তি এবং তাঁদের সংস্পর্শে আসা লোকদের শনাক্ত করে হোম কোয়ারেন্টিনে পাঠানোসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ, এসব মানুষের অনেকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন না। কেউ কেউ তথ্য গোপন করে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, অন্যদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছেন। ফলে ঝুঁকি বাড়ছে।
তাই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে এখন গ্রামাঞ্চলে হাটবাজার খোলা জায়গায় স্থানান্তর, ত্রাণ তৎপরতা বৃদ্ধি করাসহ আরও কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে মাঠ প্রশাসন। আর চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল প্রস্তুত করা এবং নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছে স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ।
দেশের আট বিভাগের বেশ কিছুসংখ্যক জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও সিভিল সার্জনের সঙ্গে কথা বলে মাঠ প্রশাসনের এসব তথ্য জানা গেছে। করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধসংক্রান্ত জেলা কমিটির সভাপতি ডিসি। মূলত মাঠপর্যায়ে তাঁদের সমন্বয়েই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় কাজ করছেন।
দেশের বিভিন্ন এলাকায় করোনাভাইরাস রোগের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় গত বৃহস্পতিবার গোটা বাংলাদেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক আবু আলী মো. সাজ্জাদ হোসেন গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, পিরোজপুরে যে চারজন রোগী শনাক্ত হয়েছেন, তার মধ্যে তিনজনই নারায়ণগঞ্জ থেকে গেছেন। আরেকজন সাভারের ইপিজেড এলাকা থেকে গেছেন। পিরোজপুর জেলাকে গত বৃহস্পতিবার লকডাউন করা হয়েছে।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সূত্রমতে, এলাকাভেদে সবচেয়ে বেশি সংক্রমণ হচ্ছে ঢাকায়। শনাক্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ৪৬ শতাংশই ঢাকা শহরের। ২০ শতাংশ রোগী নারায়ণগঞ্জের। ঢাকায় সবচেয়ে বেশি রোগী শনাক্ত হয়েছে মিরপুরে।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন কঠিনভাবে মানানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানালেন সুনামগঞ্জের ডিসি মোহাম্মদ আবদুল আহাদ। তিনি বলেন, গত বৃহস্পতিবার যে ব্যক্তিকে সিলেটে আইসোলেশনে পাঠানো হয়েছে, তিনি নারায়ণগঞ্জ থেকে এসেছেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেকে নিজ এলাকায় গেলেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ১৪ দিন বাড়িতে থাকছেন না। গতকাল শুক্রবার ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যে ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন, তিনিও সদ্য ঢাকার মিরপুর থেকে গ্রামে ফিরেছেন। শনাক্ত হওয়ার আগের দিন গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এলাকায় অনেকের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন তিনি।
- হাটবাজার খোলা জায়গায় স্থানান্তরের উদ্যোগ
অবাধ চলাচল নিয়ন্ত্রণ
পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর জোর।
রাজশাহীর ডিসি হামিদুল হক জানিয়েছেন, রাজশাহীতে লকডাউন চলছে। এখন হাটবাজারগুলো খোলা জায়গায় স্থানান্তরের কাজ চলছে। তাঁর পরামর্শ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে যাওয়া ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কোনো শৈথিল্য দেখানো যাবে না। তাঁদের অবশ্যই হোম কোয়ারেন্টিনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া জরুরি কাজে নিয়োজিত গাড়িচালকদের সংস্পর্শে আসা লোকদের বিষয়েও বাড়তি নজর দিতে হবে।
পুরো দেশকে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণার পর এ বিষয়ে করণীয় ঠিক করতে আজ শনিবার করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ–সংক্রান্ত জেলা কমিটির সভা হবে বলে জানালেন দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলম। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) আরও স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়ার চিন্তা করছেন তিনি। যেন ইউএনও তাঁর উপজেলার কোনো এলাকায় সংক্রমণ দেখা দিলেই সরাসরি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেন।
গোপালগঞ্জের ডিসি শাহিদা সুলতানা বলেন, এমনিতেই গোপালগঞ্জ লকডাউন চলছে। এর মধ্যে সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণার পর এখন বাইরের জেলা থেকে আসার বিষয়টি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
সংক্রামক আইনের প্রয়োগ বাড়বে
বর্তমানে সাধারণত সরকারি আদেশ অমান্য করার কারণে মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এখন সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের প্রয়োগও বাড়ানো হবে। এই আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি যদি সংক্রামক রোগ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বা ভুল তথ্য দেন, তাহলে এটি অপরাধ হবে। এই অপরাধের জন্য তিনি অনূর্ধ্ব দুই মাস কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। এ ছাড়া দায়িত্ব পালনে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা করলে অনূর্ধ্ব তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা যাবে। এই আইনে সংক্রমিত ব্যক্তিকে সাময়িক সময়ের জন্য কোনো জায়গায় স্থানান্তর বা জনবিচ্ছিন্ন করার বিধান রয়েছে।
পটুয়াখালীর ডিসি মতিউল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পুরো দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণার পর আইনের প্রয়োগ বাড়ানো হয়েছে।
মাঠপর্যায়ে স্বাস্থ্য বিভাগের লোকদেরও তৎপরতাও বেড়েছে। নেত্রকোনা জেলার সিভিল সার্জন তাজুল ইসলাম খান বলেন, এখন নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন তাঁরা। বিশেষ করে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুর থেকে এলাকায় যাওয়া মানুষকে শনাক্ত করে এই কাজটির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া রোগী বেড়ে গেলে আধুনিক সদর হাসপাতালকে পুরোপুরি করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে।
সিভিল সার্জন জানান, নেত্রকোনোর কেন্দুয়া উপজেলার দলপা ইউনিয়নে যে রোগীটি শনাক্ত হয়েছেন, তিনি গাজীপুর থেকে গেছেন।
এ পরিস্থিতিতে লকডাউন আরও কড়াকড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে হাটবাজার ও দোকানে ঘোরাফেরা করে সংক্রমণ বৃদ্ধি করা হচ্ছে। রিকশা ও অন্যান্য যানবাহন অবাধে চলছে। এসব কারণে ঝুঁকি বাড়ছে। সংক্রমণের সংখ্যা কমাতে হলে লকডাউন জোরদার করতে হবে।