করোনা সংক্রমণের চেয়েও বেশি ঝুঁকি নিয়ে, চারটি নদী পাড়ি দিয়ে রাজধানীতে ফিরছেন শ্রমজীবী হাজারো মানুষ। সরকার ঘোষিত লকডাউনের বাকি আরও চারদিন। এরই মাঝে রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানায় খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার প্রেক্ষিতে শনিবার (৩১ জুলাই) ভোর থেকেই দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কমপক্ষে ২১ জেলার মানুষজন মানিকগঞ্জ হয়ে তাদের কর্মস্থল রাজধানীতে ফিরছেন। এতে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বাড়ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সরজমিন দেখা যায়, ট্রলারে-নৌকায় ভোর থেকেই ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন মানুষ। প্রতিটি নৌকার এক থেকে দুইশ’র ওপর যাত্রী। সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজবাড়ি, মাগুড়া, কুষ্টিয়া, যশোরসহ আরো কয়েকটি জেলার মানুষজন উত্তাল পদ্মা, যমুনা পাড়ি দিয়ে আসছেন মানিকগঞ্জে। সেখান থেকে ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদী পাড়ি দিয়ে তারা যাচ্ছেন ঢাকার হেমায়েতপুর, সদর ঘাট ও নারায়ণগঞ্জ বন্দর এলাকায়। সড়ক পথে পুলিশী তল্লাশির কবলে পরছেন তারা। অবশ্য শ্রমিকরা তাদের পরিচয় পত্র দেখানোর পর পুলিশ যেতে দিচ্ছেন। সড়ক পথে পরিবহন সংকট, অতিরিক্ত খরচ এবং ভোগান্তি-ঝক্কি ঝামেলা এড়াতে বিকল্প পথ হিসেবে নৌ পথ বেছে নিয়েছেন এমনটি জানালেন তারা।
শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ঢাকা আরিচা মহাসড়কে যানবাহন ও মানুষের উপচে পড়া ভিড় ছিল। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় কেউ পায়ে হেঁটে, আবার কেউ পণ্যবাহী পরিবহনে ফিরছেন কর্মস্থলে। সড়কে প্রাইভেটকার, মোটর সাইকেল, রিকশা, অটো বাইকের ছড়াছড়ি। শাখা রাস্তা ও অলি-গলিতেও জনসমাগম ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই দলবদ্ধ হয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছেন পোশাক শ্রমিকরা।
সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলা থেকে এক সাথে ১৭টি নৌকায় কর্মস্থলে ফিরছেন প্রায় দুই হাজার মানুষ। ছাদ ছাড়া ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে নারী পুরুষ ও শিশুরা গাদাগাদি করে বসে আছেন। রোদ-বৃষ্টিতে সবার অবস্থা খুবই নাজুক। দুপুরের খাবারের জন্য ঘিওর উপজেলার কালীগঙ্গা নদীর পাড়ের জাবরা বাজারে ভিড়ে নৌকাগুলো। এসময় কথা হয় শাহজাদপুর উপজেলার মোনাপাশা গ্রামের মোঃ সুজনের সাথে। তিনি চাকুরী করেন নারায়ণগঞ্জের মাদার কালার গার্মেন্টেসে। জানালেন, সড়ক পথে নানা ঝামেলা এবং খরচ বেশি। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাথা পিছু ৪০০ টাকা করে ভাড়ায় তিনি যাচ্ছেন নারায়ণগঞ্জে। রবিবার থেকে গার্মেন্টেসে যোগ না দিলে চাকরী থাকবে না বলেনও জানান তিনি।
পাবনার বেড়া উপজেলার নাকালিয়া এলাকা থেকে পরিবার নিয়ে ট্রলারে রাজধানীর সদরঘাট যাচ্ছেন নুরুজ্জামান, সুমন, সোহেল। এ নৌকায় কমপক্ষে দুইশ’র ওপরে যাত্রী রয়েছে। তারা বলেন, মাথা পিছু সাড়ে তিনশ টাকায় তারা নৌকায় কর্মস্থলে যাচ্ছেন।
শাহজাদপুর উপজেলার কৈজুরি গ্রামের গার্মেন্টস কর্মী নাছিমা, নাজমা ও আঁখি আক্তার বলেন, কালকের মধ্যে গার্মেন্টেসে যোগ দিতে হবে, না হলে চাকুরী থাকবে না। করোনার এই দু:সময়ে চাকুরী চলে গেলে আমাদের পথে বসা ছাড়া আর উপায় নেই। তাই শিশু সন্তান নিয়ে জীবনের ঝুঁকির মধ্যেই ট্রলারে কর্মস্থলে যাচ্ছি।
পাবনার বেড়া থেকে ছেড়ে আসা মায়ের দোয়া পরিবহনের ট্রলার চালক মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, তিনি বেড়া থেকে ঢাকার হেমায়েতপুরে যাচ্ছেন নারী পুরুষ শিশুসহ ১৬০ জন যাত্রী নিয়ে। ভাড়া নিচ্ছেন ৩ শ টাকা করে। বেড়া থেকে যমুনা নদীতে দৌলতপুরের আমতলী ঘাট দিয়ে ঘিওরের ধলেশ্বরী নদী পাড় হয়ে কালীগঙ্গা নদী দিয়ে জামশা হয়ে হেমায়েতপুর। ভাড়া ও ঝামেলা কম থাকায় যাত্রীদের নৌকায় ভিড় একটু বেশি।
কালীগঙ্গা পাড়ের জাবরা হাটের ব্যবসায়ী মোঃ রুবেল জানান, ভোর থেকে বিকেল পর্যন্ত কমপক্ষে দুই শতাধিক যাত্রী বোঝাই ট্রলার চলাচল করেছে। অনেক নৌকাই এই হাটে জল খাবার এবং প্রাকৃতিক কার্যাদি সম্পন্ন করতে বিরতি দিয়েছে।
ঘিওর থানার ওসি মোঃ রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ বিপ্লব বলেন, সরকারী সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিল্পকারখানা খোলা, মানুষজনকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে ও সঠিক পরিচয়পত্র দেখিয়ে যেতে কোন বাধা নেই। সড়ক ও নৌ পথে সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে পুলিশ।
ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ নাজমুল ইসলাম বলেন, শনিবার সকালে মন্ত্রী পরিষদ বিভাগ থেকে নতুন পরিপত্র জারি করা হয়েছে, রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানায় কর্মরতদের কর্মস্থলে যেতে দিতে হবে। তবে মানুষজন স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মানছে না। নদী পথে নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পারাপার হচ্ছেন তারা। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যথেষ্ট প্রচার প্রচারণা ও সতর্ক করা হয়েছে।