৫ হাজার টাকায় সংসার চলে না, তাই ফজর পড়িয়ে অন্যের কাজ করতে যাই
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
জেলা প্রতিনিধি,নাটোরঃ
মুসলমানদের জীবনে ইমাম-মুয়াজ্জিন্দের গুরুত্ব অপরিসীম। আত্মমর্যাদা ও ধর্মের প্রতি ভালোবাসা থেকে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা ইবাদত হিসাবে এ পেশায় যুক্ত হন।তবে মসজিদে যোগ্য ইমাম-মুয়াজ্জিন নিয়োগের প্রতি ধর্মানুরাগী মুসলমানদের আগ্রহ থাকলেও তাদের চাহিদা ও প্রয়োজন বিবেচনা নিয়ে দেখা যায় উদাসীনতা।
শহর কিংবা গ্রাম অঞ্চল সবখানেই খুবই যত্ন সহকারে মসজিদের দায়িত্ব পালন করে থাকেন ইমাম, মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা। কিন্তু এর বিনিমিয়ে তাদের বেতন দেওয়া হয় প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলের অধিকাংশ মসজিদে শুধু নামমাত্র বেতনে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। সারাদেশের মতো ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জীবনমানের এমন চিত্র উত্তরের জেলা নাটোরেও।
ইসলামী ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, এই জেলার ৭টি উপজেলায় মোট মসজিদের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৩১টি। তবে বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি, যা প্রায় ৪ হাজারের মতো। জেলার ৮টি মডেল মসজিদ হওয়ার কথা রয়েছে। যার ভেতর দুটি উপজেলায় (বড়াইগ্রাম ও সিংড়ায়) মডেল মসজিদের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সেখানকার ইমামরা মাসিক বেতন পাচ্ছেন ১৫ হাজার, মুয়াজ্জিন ১০ হাজার ও খাদেমরা ৭ হাজার ৫০০ টাকা করে বেতন পাচ্ছেন। তবে গ্রামগঞ্জের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা মসজিদ কমিটির মাধ্যমে বেতন পেয়ে থাকেন।
সূত্র জানায়, জেলা ও উপজেলা শহর এলাকায় অবস্থিত মসজিদগুলোর ইমাম-মুয়াজ্জিনরা গ্রাম অঞ্চলের মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের চেয়ে বেশি বেতন পেয়ে থাকেন। অনেক মসজিদের চাঁদার টাকার পাশাপাশি ইমামদের জন্য বাড়ি বাড়ি থেকে তোলা হয় চাল। গ্রাম অঞ্চলের কিছু মসজিদে তুলনামূলক ভালো বেতন দিলেও সঠিক সময়ে বেতন না পাওয়ার অভিযোগ রয়েছে ইমামদের।
সরেজমিনে সদর উপজেলার বেশ কয়েকটি মসজিদে গিয়ে সেখানকার ইমাম- মুয়াজ্জিনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনরা যে বেতন পান তা দিয়ে তাদের সংসার চালাতে কষ্ট হয়। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে জীবনযাপন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। জীবনযাত্রায় সব কিছুর ব্যয় বাড়লেও তাদের বেতন বাড়েনি। ফলে পরিবার নিয়ে ভালো খাবার খাওয়ার ইচ্ছে থাকলেও তাদের পক্ষে তা সম্ভব হয় না।
এ বিষয়ে কথা হয় সদর উপজেলার ছাতনী ইউনিয়নের তেলকুপি নূরানীপাড়া আকসা জামে মসজিদের ইমাম হাফিজ মাওলানা মো. সিরাজুল ইসলাম গাজীর সঙ্গে। তিনি দীর্ঘ ১০ বছর যাবৎ ইমামতির পাশাপাশি মুয়াজ্জিনের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। স্বামী- স্ত্রী, এক কন্যা ও ৩ নাতি-নাতনি নিয়ে তার সংসার। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে তার মাসিক বেতন ৫ হাজার টাকা। তবে সেই বেতনও তিনি পান না গত দুই মাস ধরে।
জীর্ণ পাঞ্জাবি পরিহিত সিরাজুল ইসলাম বলেন, বেশ কয়েক বছর ধরে এখানে আছি ৫ হাজার টাকা বেতনে। ইমামতি, মুয়াজ্জিন ও খাদেমের কাজ একাই করি। ঠিক মতো এই বেতনটাও পাই না। মসজিদে যেই খানা (খাবার) গুলো দেয় অনেক সময় সেগুলো বাড়িতে নিয়ে যাই। ভোর রাতে ওগুলো জাল দিয়ে খাই। আজকে কয়েকদিন ধরে বাজার-ই করি না, এখান থেকে যেগুলো দেয় ওগুলোই খাই।তিনি বলেন, গত দুই মাসের বেতন পাইনি। ধার-দেনা করে এখন ১৫ হাজার টাকা ঋণ হয়ে গেছে। টাকা কিছু পেলে ঋণ দেব। এভাবেই আল্লাহ চালায় নিচ্ছে।
কথা হয় একই উপজেলার তেবাড়িয়া ইউনিয়নের দোলেরভাগ জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা শেখ ফরিদের সঙ্গে। মাওলানা শেখ ফরিদ পাশের বিলটুংগী গ্রামের বাসিন্দা। সাইকেল চালিয়ে আসেন মসজিদে। স্বামী-স্ত্রী, দুই কন্যা ও এক ছেলেসহ ৫ সদস্যর পরিবার তার। দুই কন্যা নূরী ও ফাহমিদা পাশের বাঙ্গাবাড়িয়া ইবতেদায়ী মাদরাসায় পড়াশোনা করে। মাওলানা শেখ ফরিদ বলেন, মাত্র ৮ হাজার টাকা বেতনে এতো বড় পরিবার চালানো সম্ভব হয় না। তাই পাশাপাশি অন্যর জমিতে কাজকাম করি। ফজর নামাজ পড়িয়ে অন্যের জমিতে কাজে যাই। দুপুর ১২টা থেকে সাড়ে ১২টায় কাজ থেকে ফিরে আবার মসজিদে আসি।
চিকুরমোড় জামে মসজিদে ১০ বছর ধরে ইমামতি করেন মাওলানা মোহাম্মদ মুনছর রহমান। স্বামী-স্ত্রী ও দুই মেয়ে নিয়ে সংসার তার। মাওলানা মোহাম্মদ মুনছর রহমান বলেন, আমি ৭ হাজার টাকা বেতন পাই। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই বাজারে আমাদের এই বেতন একেবারেই নগণ্য। আমিসহ গ্রাম অঞ্চলের সব ইমামরাই কষ্টে আছি। এই দুঃখের কথা তো কাউকে বলতে পারি না।
বাঙ্গাবাড়িয়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন সেকেন্দার আলী বলেন, সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। আমি এবং আমার স্ত্রী দুজনই অসুস্থ। ছেলে প্রাণ কোম্পানিতে অল্প বেতনে চাকরি করে। বর্তমান বাজারে এই টাকা দিয়ে চলতে আমাদের খুব কষ্ট হয়। এভাবেই আল্লাহ দিন চালিয়ে নিচ্ছেন।বাঙ্গাবাড়িয়া জামে মসজিদ কমিটির সভাপতি মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, গ্রামের মসজিদগুলোতে ইমাম- মুয়াজ্জিনের বেতন সময়নুযায়ী অনেক কম। এটা স্বীকার করতে হবে। গ্রামের মানুষের থেকে আমরা চাঁদা তুলে তাদের বেতন দিয়ে থাকি। এ বছর বেতন নির্ধারণ হয়েছে, আমরা আগামীবার চেষ্টা করব তাদের সুযোগ-সুবিধা (বেতন) বাড়িয়ে দেওয়ার। ইমাম-মোয়াজ্জিনদের এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
নাটোর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক মো. ইমামুল ইসলাম বলেন, জেলায় মোট মসজিদের সংখ্যা ৩ হাজার ৬৩১টি। ৭টি উপজেলায় ৮টি মডেল মসজিদের অনুমোদন পেয়েছে। এর ভেতর দুটির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান। আমাদের দেশে মসজিদ যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে এভাবে মসজিদ পরিচালনার কোনো বিধি নেই। ইমাম মুয়াজ্জিন নিয়োগেও কোনো নিয়ম কানুন এখন পর্যন্ত হয়নি। যার ফলে, একজন ইমামকে যেই সম্মানি দেওয়া হয় তা দিয়ে ৪-৫ সদস্যর সংসার চালানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। কিছু কিছু মসজিদে আয়ের পরিমাণ কম হওয়ায় অনেক সময় এই সামান্য সম্মানিটাও পেতে বিলম্ব হয়। কমিটির কাছে এই সম্মানী চাইতেও অনেক সময় তারা অপমান বোধ করেন।
তিনি বলেন, আমাদের ঊর্ধ্বতন ফোরামের আলোচনায় আমরা জানিয়েছি ইমাম সাহেবদের চাকরির বিধি হওয়া দরকার। যে বিধিতে ইমাম সাহেবদের স্বার্থ সংরক্ষিত করা হবে।ইমাম-মুয়াজ্জিনদের আর্থিক অসচ্ছলতা দূরীকরণে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ আছে কিনা জানতে চাইলে নাটোরের জেলা প্রশাসক আবু নাছের ভূঁঞা বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে জেলার তালিকাভুক্ত শিক্ষকরা বেতন পেয়ে থাকেন। অনেক মসজিদের ইমামরা সেখানে শিক্ষকতা করেন। সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান মসজিদের উন্নয়নে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের জন্য সরকারের যদি নতুন কোনো পরিকল্পনা থাকে তা বাস্তবায়নে আমরা কাজ করব।