প্রকাশিত: ১০:১০ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ৫, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিনিধি:

বাংলাদেশের কৃষিখাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হলো হর্টিকালচার (ঐড়ৎঃরপঁষঃঁৎব), যা ফল, সবজি, ফুল, মসলা ও ওষধি গাছের চাষ অন্তর্ভুক্ত করে। উর্বর মাটি, অনুকূল জলবায়ু এবং ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত উন্নতির কারণে বাংলাদেশে হর্টিকালচার ফসলের উৎপাদন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে।

হর্টিকালচার ক্রপ (ঐড়ৎঃরপঁষঃঁৎব ঈৎড়ঢ়) বলতে সেইসব ফসলকে বোঝায়, যা উদ্যানবিদ্যা (ঐড়ৎঃরপঁষঃঁৎব) বা উদ্যানচাষের (এধৎফবহ ঈঁষঃরাধঃরড়হ) আওতাভুক্ত। এসব ফসল সাধারণত ফলফলাদি, সবজি (খাদ্য) সৌন্দর্যবর্ধন, মসলা ও ঔষধি গুণের ফসল চাষ করা বোঝায়। সাধারণ ভাষায় একে হাইভ্যালু ক্রপও বলা হয়।

হর্টিকালচার ফসল কেবল কৃষি ক্ষেত্রেই নয়, খাদ্য, স্বাস্থ্য, পরিবেশ এবং অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। এর চাষ বৃদ্ধি পেলে কৃষকদের আয় বাড়বে, পুষ্টির ঘাটতি কমবে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ফলের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় রপ্তানির সম্ভাবনাও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

বাংলাদেশে প্রায় ১ কোটি মেট্রিক টনের বেশি ফল উৎপাদিত হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০০-১৫০ কোটি টাকার ফল ও সবজি রপ্তানি করা হয়। আম, কাঁঠাল, লিচু, মাল্টা, পেঁপে, আনারস, ড্রাগন, স্ট্রবেরিসহ অসংখ্য ফল, সবজি, ফুল এবং মসলা যা দেশে উৎপাদিত হচ্ছে এবং বিদেশি রপ্তানি হচ্ছে। বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের যেসব ফল, সবজি রপ্তানি হয় তার পরিমাণ এবং পরিসর আরও বাড়ানো সম্ভব। বাংলাদেশে প্রচুর হর্টিকালচার ফসল উৎপাদিত হয়, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো আম।

…উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তির অভাব, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উন্নত কোল্ড স্টোরেজ ও প্যাকেজিং সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। নতুন বাজার খোঁজা ও রপ্তানি নীতি সহজ করতে হবে।

কথাসাহিত্যে অসংখ্যবার আম-কাঁঠালের কথা উল্লেখ রয়েছে। এর কারণ হলো আম বা কাঁঠালের ফলন বেশি দেখে তা সাহিত্যেও স্থান পেয়েছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, সাতক্ষীরা, মেহেরপুর, সাপাহার এবং দিনাজপুরে ব্যাপকভাবে আম উৎপাদিত হয়। বছরে প্রায় ২৫-৩০ লাখ মেট্রিক টন আমের ফলন হয়। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আম রপ্তানি হয়।

কাঁঠাল জাতীয় ফল হিসেবে পরিচিত এবং প্রায় সব জেলাতেই পাওয়া যায়। নরসিংদী, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামে কাঁঠালের ফলন ভালো। বছরে ১৫-১৮ লাখ মেট্রিক টন কাঁঠাল উৎপাদিত হয়। স্থানীয়ভাবে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি, প্যাকেটজাত কাঁঠালের চাহিদা বাড়ছে।

আম-কাঁঠালের পরেই অবস্থান কলার। নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, বগুড়া, ময়মনসিংহ, যশোর ও কুমিল্লায় ব্যাপকভাবে কলার চাষ হয়। বছরে ১২-১৫ লাখ মেট্রিক টন কলা উৎপাদিত হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতারসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কলা রপ্তানি হয়।

গ্রীষ্মের মধু ফলের মধ্যে অন্যতম হলো লিচু। লিচু দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়াতে প্রধানত চাষ হয়। বছরে ১.৫-২ লাখ মেট্রিক টন লিচু উৎপাদিত হয়। ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি লিচুর চাহিদা বেশি।

আরেক রসালো ফল হলো কমলা ও মাল্টা। পার্বত্য চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, সিলেটে ও চুয়াডাঙ্গা তা বেশি উৎপাদিত হয়। বছরে ১.৫-২ লাখ মেট্রিক টন কমলা ও মাল্টা উৎপাদিত হয়। কমলা ও মাল্টার রপ্তানি ফল হলেও ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি ফলের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া পেঁপে, আনারস, তরমুজ, বরইসহ অসংখ্য ফলের চাহিদা দেশে এবং বিদেশে প্রচুর রয়েছে।

ফল রপ্তানির সম্ভাবনা:

বাংলাদেশের ফল এবং সবজি রপ্তানি বাজার দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই খাতকে আরও এগিয়ে নেওয়ার কিছু সম্ভাবনা, উদ্যোগ, গুণগত মান উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা জরুরি। গ্লোবাল গ্যাপ (এষড়নধষ এঅচ) এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মানদণ্ড মেনে উৎপাদন বাড়ানো গেলে রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে। জৈব ও নিরাপদ ফল উৎপাদনের দিকে নজর দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সহজ হবে।

প্রক্রিয়াজাত ও সংরক্ষণ প্রযুক্তির উন্নয়ন: ফল, সবজির পাশাপাশি হিমায়িত ও প্রক্রিয়াজাত ফলের চাহিদা বাড়ছে (যেমন ম্যাংগো পাল্প, ড্রাই ফ্রুটস, জুস)।

চ্যালেঞ্জ ও সমাধান: সঠিক সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণের অভাব, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম ও হিমাগার স্থাপন প্রয়োজন। উন্নত চাষাবাদ প্রযুক্তির অভাব, কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

উন্নত কোল্ড স্টোরেজ ও প্যাকেজিং সিস্টেম গড়ে তুলতে হবে। নতুন বাজার খোঁজা ও রপ্তানি নীতি সহজ করতে হবে। ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার দেশগুলোয় বাংলাদেশি ফলের চাহিদা বাড়ছে। সরকারিভাবে রপ্তানি সহায়তা ও লজিস্টিকস সুবিধা বাড়ালে রপ্তানি সহজ হবে।

রপ্তানিকারকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বাড়াতে হবে। রপ্তানিতে ভর্তুকি ও ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিলে কৃষকরা রপ্তানিতে অনেক বেশি উৎসাহী হবে। সরকার ও বেসরকারি খাত মিলে রপ্তানিযোগ্য ফলের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কাজ করছে।

সবজি: বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১.৭ কোটি মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয়। বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজর, শিম, মিষ্টিকুমড়া, লাউ, করলা, শসা, ঢেঁড়স ইত্যাদি প্রধান সবজি। উন্নত জাত ও চাষপদ্ধতি ব্যবহারের ফলে সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে।

বাংলাদেশ থেকে সবজি রপ্তানির পরিমাণ সাম্প্রতিক বছরগুলোয় উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সবজি রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১৮২ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কমে মাত্র ৭৫ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, ফল ও সবজি মিলিয়ে ২০১৩-১৪ অর্থবছরে রপ্তানি আয় ছিল ২৩৯.১৯ মিলিয়ন ডলার, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে কমে ৭৪.৯৩ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

এই হ্রাসের পেছনে উচ্চ রপ্তানি ব্যয়, ভালো কৃষি অনুশীলন বা গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস (এঅচ) অনুসরণের অভাব এবং প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাবসহ বিভিন্ন কারণ ভূমিকা রেখেছে। এছাড়া, বিমান পরিবহন খরচ বৃদ্ধি এবং প্রতিযোগী দেশগুলোর তুলনায় প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়াও রপ্তানি হ্রাসের অন্যতম কারণ। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের কৃষি রপ্তানি খাতের জন্য উদ্বেগজনক এবং এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন।

রপ্তানিকারকদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বাড়াতে হবে। রপ্তানিতে ভর্তুকি ও ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিলে কৃষকরা রপ্তানিতে অনেক বেশি উৎসাহী হবে।

মসলা ফসল: রসুন, পেঁয়াজ, আদা, হলুদ, ধনিয়া, জিরা, মরিচ ইত্যাদি মসলা ফসলের চাষ দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশে পেঁয়াজ ও রসুনের চাহিদা বাড়ায় এগুলোর উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।

ফুল চাষ: গোলাপ, রজনীগন্ধা, গ্লাডিওলাস, গাঁদা ও জারবেরা প্রধানত উৎপাদিত হয়। যশোরের গদখালীকে বাংলাদেশের ‘ফুলের রাজধানী’ বলা হয়।

ওষধি গাছ: তুলসী, অশ্বগন্ধা, কালোজিরা, নিম, মেহেদী, ঘৃতকুমারী, বাসক ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ওষধি গাছ হিসেবে চাষ হয়।

নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার: টিস্যু কালচার, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গ্রিনহাউজ, কৃষিতে অও প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ফলন বাড়ানো সম্ভব। হাইব্রিড ও জিএমও জাতের ফসলের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ছে।

নতুন জাতের উন্নয়ন: বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট (ইঅজও) ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিভিন্ন উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন করছে। দেশীয় ও বিদেশি বাজারে প্রতিযোগিতার জন্য উন্নত মানের জাত উৎপাদন করা হচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা: খরা, বন্যা ও লবণাক্ততা সহনশীল জাতের উন্নয়ন করা হচ্ছে। উঁচু জমিতে ফল ও সবজি চাষ করে এবং ফসল ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থাপনা করে ক্ষতির পরিমাণ কমানো হচ্ছে।

ফল প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের বিকাশ: প্যাকেজিং, সংরক্ষণ, ও প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ম্যাঙ্গো জুস, ফ্রোজেন সবজি, ড্রাই ফ্রুটস ইত্যাদির চাহিদা বাড়ছে।

শহুরে কৃষি ও ছাদ বাগান: শহরে হাইড্রোপনিক্স, অ্যারোপনিক্স এবং ছাদ বাগান চাষ বাড়ছে। হাইড্রোপনিক হলো এক ধরনের মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি, যেখানে উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরাসরি পুষ্টিসমৃদ্ধ পানির মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। এই পদ্ধতিতে গাছ মাটির পরিবর্তে পুষ্টিযুক্ত জলীয় বা অন্য কোনো ইনঅ্যারগানিক (নিষ্ক্রিয়) মাধ্যম যেমন কোয়াকিং পাথর, নারিকেলের ছোবড়ার সাহায্যে জন্মায়।

অ্যাকোয়াপনিক (অয়ঁধঢ়ড়হরপ) চাষ হলো হাইড্রোপনিক্স (মাটিবিহীন চাষ) এবং অ্যাকুয়াকালচার (মাছ চাষ) এর সংমিশ্রণ, যেখানে মাছ ও উদ্ভিদের মধ্যে একটি প্রাকৃতিক পুনঃচক্রায়ন (ৎবপরৎপঁষধঃরড়হ ংুংঃবস) তৈরি করা হয়। অর্থাৎ মাটিবিহীন অবস্থায় একই সাথে মাছ এবং নির্বাচিত ফসল চাষ করা হয়। এই পদ্ধতিতে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হচ্ছে এবং ফরমালিনমুক্ত ফল-সবজি পাওয়া যাচ্ছে।

জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ: জলবায়ু সহনশীল জাতের উন্নয়ন ও বিকল্প কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দুর্যোগ মোকাবিলায় ফসল ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থাপনা করা।

বাংলাদেশে হর্টিকালচার খাতের সম্ভাবনা ব্যাপক। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ, আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে এই খাতকে আরও সমৃদ্ধ করা সম্ভব। সঠিক পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ শুধু দেশীয় চাহিদা মেটানোই নয়, বরং আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে পারবে।

বাংলাদেশে ফল উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে এবং রপ্তানির সম্ভাবনাও ব্যাপক। আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ, মানসম্মত সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই খাতকে আরও লাভজনক করা সম্ভব। সরকারের সঠিক নীতি ও কৃষকদের উদ্ভাবনী প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাংলাদেশ অদূর ভবিষ্যতে বৈশ্বিক ফল রপ্তানির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হতে পারে।