নানা সমস্যায় জর্জরিত নেত্রকোণা বিসিক শিল্প নগরী

প্রকাশিত: ১১:১৪ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ৫, ২০২৪

নেত্রকোণা প্রতিনিধি:

গ্যাস সংযোগ না থাকা, পর্যাপ্ত নিরাপত্তার অভাব, ড্রেনেজ ব্যবস্থা, শিল্প এলাকার ভেতরের রাস্তার বেহাল দশাসহ নানান সমস্যায় জর্জরিত নেত্রকোণা বিসিক শিল্প নগরী।

এই শিল্প নগরীতে চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও অধিকাংশ ইউনিটে উৎপাদনই শুরু হয়নি। যেসব প্রতিষ্ঠান উৎপাদন শুরু করেছে, সেগুলোর সিংহভাগই বিভিন্ন সংকটের কারণে বন্ধ থাকে বলে জানিয়েছেন কারখানা সংশ্লিষ্টরা।

২০০৭ সালে নেত্রকোণা সদরের রাজেন্দ্রপুর এলাকায় ভূমি অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিসিকের কার্যক্রম শুরু হলেও ১৭ বছরেও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়নি নেত্রকোণা বিসিক শিল্প নগরী। মোট ১৫ একর জমিতে ১০৩টি প্লটের ৬৮টি বাণিজ্যিক ইউনিটের সবগুলোই বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বহু বছর আগেই।

বরাদ্দ পাওয়ার তিন বছরের মধ্যে উৎপাদনে যাওয়ার চুক্তি থাকলেও ৬৮টি ইউনিটের মধ্যে ৩৬টি ইউনিটে উৎপাদন শুরু হয়নি। বাকি ৩২টিতে বিসিক কর্তৃপক্ষ কাগজে কলমে উৎপাদন চালু থাকার দাবি করলেও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, বিসিকে বর্তমানে ৭-৮টি প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে। তবে বিসিক কর্তৃপক্ষ বলছে নিয়মিত উৎপাদনে রয়েছে ২০টির ওপরে প্রতিষ্ঠান। মূলত গ্যাস, বিদ্যুৎসহ জ্বালানি সংকটের কারণে উৎপাদনে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়ছে। এমতাবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস সরবরাহের দাবি জানান তারা।

প্রিয়া ফুড প্রোডাক্টসের কর্মচারী সুমন সাহা বলেন, আমরা বারবার গ্যাস চাচ্ছি, কিন্তু পাচ্ছি না। আমাদের এখানে বেশ কিছু ফ্যাক্টরি আছে, যেগুলো এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এগুলোকে বাঁচাতে হলে আমাদের গ্যাসের সংযোগ পাওয়াটা খুব জরুরি। তাহলে আমাদের প্রোডাকশন খরচ কমে আসবে। কাঠের লাকড়ি দিয়ে প্রোডাকশন করতে খরচ অনেক বেড়ে যায়। আমরা চাচ্ছি গ্যাস তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করা হোক, তাহলে লাকড়ি দিয়ে জ্বালানির ব্যবস্থা করতে গিয়ে যে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে সেটা আর হবে না। পাশাপাশি আমরা কম দামে বাজারে প্রোডাক্ট দিতে পারব। এতে করে ক্রেতারাও কম টাকায় জিনিসপত্র কিনতে পারবেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তৈরি পোশাক কারখানার মালিক বলেন, নেত্রকোণা বিসিক শিল্প নগরীতে কোনো গ্যাস সংযোগ নেই। আমরা একমাত্র বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল। সে ক্ষেত্রে আমাদের গ্যাসের সাপ্লাইটা যদি থাকতো তাহলে আমাদের উৎপাদনের খরচ কম হতো। যেমন আমাদের ওয়াশিং প্লান্ট চালাতে গেলে গ্যাসের প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে আমরা সিলিন্ডার গ্যাস দিয়ে কাজ চালিয়ে নিচ্ছি। এখানে যদি আমাদের সরাসরি গ্যাস সংযোগ থাকতো তাহলে আমাদের উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটতো না। আমরা সঠিক সময়ে উৎপাদন এবং ডেলিভারি দিতে পারতাম। এখন যেহেতু গ্যাসের সংকট তাই আমাদের সঠিক সময়ে মাল ডেলিভারি দিতে হিমশিম খেতে হয়। পাশাপাশি রাস্তাঘাটের অবস্থা খুব খারাপ। বৃষ্টি হলে রাস্তা তলিয়ে যায়। এখানে কোনো ড্রেনের ব্যবস্থা নেই। এসব কারণে এখানকার পরিবেশ খুবই নোংরা থাকে। যে কারণে আমাদের যারা কাস্টমার ভিজিটে আসেন। অথবা যারা আমাদের কাজ দেন, তারা পরিবেশ দেখে কাজ দিতে চান না। পাশাপাশি সন্ধ্যার পর এখানে বাহিরের লোকজন এসে আড্ডা দেয়, কোনো নিরাপত্তা নেই।

মাসুম বিল্লাহ নামের এক ফ্যাক্টরি ম্যানেজার বলেন, আমাদের বিসিকে বর্তমানে অনেকগুলো সমস্যা আছে। এর মধ্যে একটি হল ড্রেনেজ ব্যবস্থা। এটির খুব খারাপ অবস্থা। বর্ষাকালে আমাদের রাস্তাঘাট সব পানিতে তলিয়ে যায়। রাস্তায় কাদা থাকে, এখানে আসা যাওয়া খুব কষ্ট। একটা গাড়ি যে এসে ভেতরে ঢুকবে সেটাও সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের যারা শ্রমিক আছে তাদেরও আসা-যাওয়ার একটা সমস্যা তৈরি হয়। পাশাপাশি আমাদের নিরাপত্তার একটি সমস্যা আছে। কারণ এখানে বাইরের লোক যাতায়াত করে। আমাদের দাবি থাকবে এখানে সিকিউরিটির মান একটু উন্নয়ন করা হোক। পাশাপাশি রাস্তাঘাট ভালো করুক। তাহলে বিসিকের মান আরো উন্নয়ন হবে এবং আমাদের যারা বায়ার আছেন তারা আমাদের খুব সহজে কাজ দেবেন।

বিসিক পুরোদমে চালু হলে হাজারো মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে তাই বরাদ্দকৃত প্রতিটি ইউনিট চালু করা এবং সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দাবি ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের।

নেত্রকোণা বিসিক জেলা কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপব্যবস্থাপক শিরিন ইসলাম জানান, বিসিক জেলা কার্যালয়ের আওতাধীন ১৫ একর জমির উপর নেত্রকোণা বিসিক শিল্প নগরীটি অবস্থিত। এ শিল্প নগরীতে গ্যাস সরবরাহ করতে পারলে প্রায় ৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এতে করে সকল শিল্প মালিকরা উপকৃত হবেন। পাশাপাশি নেত্রকোণা সকলেই উপকৃত হবেন। গ্যাসের জন্য বিসিক ইতিমধ্যেই ১৩ কোটি ৫০ লক্ষ টাকার একটি প্রাক্কলিত ব্যয় তৈরি করে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে যদি এই বাজেটটি পাওয়া যায় তাহলে অচিরেই নেত্রকোণা বিসিক শিল্প নগরীতে গ্যাস সরবরাহ করা যেতে পারে। গত ২৭ শে আগস্ট ভূমি বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনা কমিটির মাধ্যমে একটি সভায় সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে যে, চুক্তি মোতাবেক সময়ে অবকাঠামো নির্মাণ করতে পারেনি বা উৎপাদনে যেতে পারেনি তাদের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

নেত্রকোণা জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, আমাদের এ বিসিক শিল্প নগরীতে যে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো গড়ে উঠেছিল, সেখানে গ্যাসের সংযোগ না থাকায় তাদের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এটা হচ্ছে একটা সরকারের পলিসির বিষয়। যেহেতু শিল্প নগরীটি চালু হয়েছে, আমরা সরাসরি সরকারকে জানাবো। এখানে যদি গ্যাসের সংযোগ দেওয়ার সুযোগ থাকে তাহলে, এখানে কর্মসংস্থান তিনগুণ বেড়ে যাবে এবং নেত্রকোণা জেলাবাসি উপকৃত হবে। কারণ নেত্রকোণা জেলাতে কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান নেই, এটি একটি শ্রমনির্ভর জেলা। পাশাপাশি আমরা যদি এখানে শিল্প নগরীটা প্রতিষ্ঠিত করতে পারি এখানে ক্যাপাসিটি বিল্ডআপ করতে পারি তাহলে, নেত্রকোনাবাসী উপকৃত হবে। আপনারা জানেন এখানে ১০৩টি প্লট ৬৮ জন শিল্প মালিকদের মধ্যে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এক্টিভ রয়েছে ৩২টি প্রতিষ্ঠান। অন্য শিল্প প্রতিষ্ঠান আসছে না প্রতিকূল পরিবেশের কারণে। তিন বছরের মধ্যে এই শিল্প মালিকরা যদি না আসেন তাহলে আমরা তাদের নোটিশ করব। তারা যদি আসেন তাহলে ভালো। যদি না আসেন তাহলে আমরা নতুন করে শিল্প মালিকদের আহ্বান করব এখানে আসার জন্য।