বারবার খনন করেও প্রাণ ফিরছে না খাকদোন নদীর

প্রকাশিত: ১২:৩০ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২৩, ২০২৪

বরগুনা প্রতিনিধি:

বরগুনা থেকে ঢাকা যাওয়ার একমাত্র নৌপথ খাকদোন নদী। এই পথ দিয়েই ঢাকার উদ্দেশে চলাচল করে সব ধরনের নৌযান। বর্তমানে খাকদোন নদীর বিভিন্ন জায়গায় চর পড়ে নৌপথটি প্রায় বন্ধের পথে। বর্ষা মৌসুমে এ নদীতে লঞ্চ চলাচলে পানি প্রবাহ স্বাভাবিক থকলেও শীতে অর্থাৎ শুষ্ক মৌসুমে পানি কমে যায়। ফলে নাব্যতা না থাকায়, বিশেষ করে ভাটার সময় লঞ্চগুলো বরগুনা পৌরসভার নদীবন্দর ঘাট পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না। এতে স্বাভাবিকভাবে লঞ্চ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে, ভোগান্তিতে পড়েন চলাক ও যাত্রীরা। তবে খাকদোন নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে সমস্যা সমাধানে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বরগুনা নদীবন্দর কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসন।বরগুনার খাকদোন নদীর এ নৌরুটকে সচল রাখতে প্রায় বছরই বিভিন্ন স্থানে ড্রেজিং বা খনন কাজ করা হয়। এমনকি সারাবছর ধরেই নদীতে ভাসমান অবস্থায় বাধা থাকে ড্রেজিং মেশিন। তবে বিভিন্ন সময়ে নদীতে ড্রেজিং করা হলেও ফিরছে না নদীর নাব্যতা। এতে শীত মৌসুম শুরু হলে ভাটার সময় পানি কমে গেলে লঞ্চসহ সব বড় নৌযান চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এ সময় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা লঞ্চগুলো বরগুনার নদীবন্দর পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারায় পৌরশহর থেকে প্রায় দুই-তিন কিলোমিটার দূরে নোঙর করতে হয়। আবার বরগুনা থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময়ও একই অবস্থার সৃষ্টি হয়।

খাকদোন নদীতে এমন ড্রেজিং নিয়ে বরগুনাগামী লঞ্চগুলোর বিভিন্ন স্টাফ ও সাধারণ মানুষের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নৌযান শ্রমিক ও চালকরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাবে ড্রেজিং করার পরও তেমন কোনো সুফল মিলছে না। স্থানীয় সচেতন নাগরিকদের দাবি, শুধু লোক দেখানো ড্রেজিং করা হয়। ফলে খাকদোন নদীর নাব্যতা ফিরছে না।

বরগুনা থেকে ঢাকাগামী পূবালী-১ লঞ্চের মাস্টার মো. হারুন অর রশীদ বলেন, শীত মৌসুমে খাকদোন নদীর নাব্যতা হারায়। এ সময় পানির সংকট দেখা দিলে জাহাজ নিয়ে ঘাটে যেতে পারি না। নদীতে ড্রেজিং করা হলেও আশপাশের কিছু কিছু খাল রয়েছে যেগুলোতে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে ওই খালগুলোর পানি খাকদোন নদীতে নামতে পারে না। এ কারণে স্রোত কমে গিয়ে নদী ভরাট হয়ে যায়। লঞ্চ চলাচল করতে স্বাভাবিকভাবে নদীতে দেড় মিটার পানি থাকার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু মাঝেমধ্যে খাকদোন নদীতে এক মিটার পানি থাকে। এ সময় লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতে না পেরে দূরে নোঙর করে রাখতে হয়। এতে যাত্রীদের ওঠা-নামায় ভোগান্তির সৃষ্টি হওয়ায় অনেকেই লঞ্চ যাত্রা বাদ দিয়ে ভিন্ন উপায়ে সড়ক পথে যাতায়াত করেন। এ ছাড়া ব্যবসায়ীদের মালামাল পরিবহনেও সমস্যায় পরতে হয়। লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক রাখতে এবং নদীর নাব্যতা ফেরাতে দীর্ঘমেয়াদি ড্রেজিং পরিকল্পনা করতে হবে বলে জানান তিনি।
একই লঞ্চের আরেক মাস্টার মো. আবুল হোসেন বলেন, বড় নদীতে যে গতিতে আমরা জাহাজ চালিয়ে আসি, খাকদোন নদীর নাব্যতা না থাকায় সেই গতিতে চালাতে পারি না। জাহাজের গতি কম থাকায় বরগুনা নদীবন্দরে পৌঁছাতে আমাদের দেরি হয়। এতে যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ে আমাদেরও জাহাজ চালাতে কষ্ট হয়। তবে খাকদোন নদীতে যদি সুন্দরভাবে উপযোগী করে ড্রেজিং করা হয় তাহলে আমাদের এ সমস্যা দূর হবে এবং লঞ্চে যাত্রী সংখ্যাও বাড়বে।

লঞ্চের স্টাফ মো. রিপন বলেন, ভাটার সময় যখন নদীর পানি শুকিয়ে যায় তখন লঞ্চ চালিয়ে আমরা ঘাট পর্যন্ত আসতে পারি না। এছাড়া যখন একেবারে পানি শুকিয়ে যায় তখন ঘাট থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ঢলুয়া নামক এলাকায় যাত্রী নামাতে হয়। তবে বছরের পর বছর নদীতে ড্রেজিং মেশিন বাধা থাকতে দেখি, কিন্তু কোনো কাজের কাজ হয় না। যদি খাকদোন নদীর ড্রেজিং সঠিকভাবে করা হয়, তাহলে আমরা ঘাট পর্যন্তই যাত্রী নিয়ে আসতে পারব।

বরগুনার স্থানীয় সচেতন নাগরিক মুরাদুজ্জামান টিপন  বলেন, খাকদোন নদীতে নামমাত্র ড্রেজিং করা হয়। প্রয়োজন অনুযায়ী ড্রেজিং করা হয় না। ঘাট থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে লঞ্চ থেকে যাত্রীদের নামতে হয়। অথচ ড্রেজার মেশিন নদীতে থাকলেও তারা নদী খনন করে না। মাঝেমধ্যে যে খনন করা হয় তা কেবল লোক দেখানো।

বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিটির বরগুনা জেলা শাখার সদস্য আরিফুর রহমান বলেন, খাকদোন নদীতে প্রতিবছর অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করা হচ্ছে। আমরা এই ড্রেজিংয়ের কোনো সুফল পাচ্ছি না। শীত মৌসুমে লঞ্চঘাট পর্যন্ত লঞ্চ আসতে না পারায় ঘাট থেকে অনেক দূরে নোঙর করে রাখতে হয় এবং সেখানেই যাত্রীদেরকে নামানো এবং ওঠানো হয়। ভবিষ্যতে খাকদোন নদীতে ড্রেজিংয়ের সুফল যদি না পাই তাহলে আমরা পরিবেশকর্মীরা খাকদোন নদীর নাব্যতা ফেরাতে বৃহৎ আন্দোলন করব। আমরা সরকারের সুনজরের মাধ্যমে খাকদোন নদীর অপরিকল্পিত ড্রেজিং বন্ধ করে পরিকল্পিতভাবে ড্রেজিং করতে আহ্বান জানাই।
প্রতিবছর শীত মৌসুমে খাকদোন নদীর পানি কমে যায়। এতে লঞ্চসহ সব ধরনের বড় নৌযান চলাচলে সমস্যার সৃষ্টি হয়। যাত্রী ভোগান্তি দূর করে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক করতে কি ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে জানতে চাইলে বরগুনা নদীবন্দরের সহকারী বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা সৈয়দ মো. মাহবুবুর রহমান  বলেন, শুষ্ক মৌসুমে নদীতে যখন জোয়ার থাকে তখন তেমন একটা সমস্যা হয় না। তবে ভাটার সময় বড় নৌযানগুলোর গতি কমিয়ে চালাতে হয়। এ মৌসুমে খাকদোন নদীর যে নাব্যতা সংকট দেখা দেয় তা সমাধানের লক্ষ্যে ইতোমধ্যেই বিআইডব্লিউটিএয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ নদীর গভীরতা এবং নদী পরিদর্শন করেছেন। এর পাশাপাশি নদীর নাব্যতা সংকট দূরীকরণে বন্দর কর্মকর্তা হিসেবে আমাদের ড্রেজিং বিভাগকেও এ বিষয়ে অবগত করেছি।

বরগুনা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শফিউল আলম  বলেন, খাকদোন নদীই বরগুনা থেকে ঢাকা যাওয়ার একমাত্র নৌপথ। এ পথ হয়েই লঞ্চগুলো ঢাকার উদ্দেশে চলাচল করে। বর্তমানে খাকদোন নদীর বিভিন্ন জায়গায় চর পড়ে এ নৌপথটি প্রায় বন্ধের পথে। যদিও এখন পর্যন্ত জোয়ারের সময় জাহাজগুলো ঘাট পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। তবে ভাটার সময় পৌঁছানো একটু কঠিন হয়। আমাদের এই নৌপথটি সচল রাখতে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।