এসএম দেলোয়ার হোসেন:
নাম তার শাহজাহান ভূঁইয়া। বয়স এখন ৭৩। হত্যা-ডাকাতি আর অস্ত্রবাজিই ছিলো যার নেশা। সেই সময়ে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি ছিলেন মূর্তমান আতঙ্ক। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় অপরাধের বীজ বপন করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে পড়েন তিনি। দেশের বিভিন্ন স্থানে তার নামে হত্যা-ডাকাতিসহ মোট ৩৬টি মামলা হয়। এসব মামলায় বিজ্ঞ আদালতের বিচারক শাহজাহান ভূঁইয়াকে ১৪৩ বছরের জেল দেন। কারাগারে থেকে দেশে-বিদেশে বহুল আলোচিত জেএমবির শীর্ষ জঙ্গি নেতা বাংলা ভাই ও চারজন যুদ্ধাপরাধীসহ দেশের বিভিন্ন আলোচিত মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেন জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। কারাগারের সেই আলোচিত জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া ৩২ বছর কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পাচ্ছেন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজ রোববার (১৮ জুন) যেকোনো সময় কারাগারের চার দেওয়াল থেকে ছাড়া পেয়ে অন্ধকার প্রাচীর ছেড়ে মুক্ত বাতাসে বেরিয়ে আসতে পারেন তিনি। গতকাল শনিবার (১৭ জুন) রাতে নিউজ পোস্ট বিডিকে এসব তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ।
কারাগারের নথি পর্যালোচনা করে তিনি জানান, ১৯৭৯ সালে আটক হওয়ার আগে ও পরে শাহজাহানের নামে সর্বমোট ৩৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি অস্ত্র মামলা, একটি ডাকাতি মামলা এবং বাকি ৩৪টি হত্যা মামলা।
বিচারকাজে দেরি হওয়ার কারণে সাজা ছাড়াই তিনি ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত ১৭ বছর হাজতি হিসেবে কারাগারে থাকেন। ১৯৯৫ সালে তার সাজা হয় ১৪৩ বছরের। পরে ৮৭ বছরের সাজা মাফ করে তাকে ৫৬ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
ফাঁসি কার্যকর ও সশ্রম কারাদণ্ডের সুবিধার কারণে সেই সাজা ৪৩ বছরে এসে নামে। দুটি মামলায় পাঁচ হাজার টাকা করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাস করে অতিরিক্ত এক বছর জেল খেটে ৩২ বছর পর অবশেষে মুক্ত আকাশের নিচে শ্বাস ফেলার সুযোগ পাচ্ছেন জল্লাদ শাহজাহান।
কারা সূত্রে জানা গেছে, সাজার মেয়াদ কমানোর বাসনায় কয়েদি থেকে জল্লাদ বনেছেন শাহজাহান। একের পর এক অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছেন চার দেওয়ালের বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পেতে। অবশেষে সেই বাসনা রোববার (১৮ জুন) যেকোনো মুহুর্তে সত্যি হতে যাচ্ছে।
সিনিয়র জেল সুপার সুভাষ কুমার ঘোষ নিউজ পোস্ট বিডিকে জানান, জল্লাদ শাহজাহান ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৬ জনের ফাঁসি দিয়েছেন। এর মধ্যে ছয়জন বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, চারজন যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গি নেতা বাংলাভাইসহ দুজন জেএমবি সদস্য এবং আরও ১৪ জন অন্যান্য আলোচিত মামলার আসামির ফাঁসি কার্যকর করেছেন জল্লাদ শাহজাহান।
কেন্দ্রীয় কারাগারের এই কর্মকর্তা আরও জানান, জল্লাদ শাহজাহানের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ থাকার কারণে তার আবেদনের প্রেক্ষিতে জরিমানার ১০ হাজার টাকা কারা কর্তৃপক্ষ পরিশোধ করেছে।
১৯৮৯ সালে সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে শাহজাহান তার জল্লাদ জীবনের সূচনা করেন। এরপর কারাগারে কারও মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সময় আসলেই ডাক পড়তো তার। টানা আট বছর এই কাজ করার পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেন।
শাহজাহান ভূঁইয়া আটকের নেপথ্যে: একটি নারীঘটিত ঘটনার পরে শাহজাহান বাংলাদেশের একজন বহুল পরিচিত সন্ত্রাসীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। তাছাড়া কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর থেকে যেকোনো ‘অপারেশনে’ তার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য অপারেশন করেছিলেন ১৯৭৯ সালে মাদারীপুর জেলায় এবং এটাই ছিল তার জীবনের সবশেষ অপারেশন। অপারেশন শেষে মানিকগঞ্জ হয়ে ঢাকায় ফেরার চেষ্টা করছিলেন শাহজাহান। তবে গোপন সূত্রে পুলিশের কাছে পৌঁছে যায় সেই খবর। মানিকগঞ্জে পুলিশ চেকপোস্ট বসালে শাহজাহান তার ওই এলাকার বাহিনীর মাধ্যমে তা জানতে পারেন। কিন্তু সব জেনেও ওই এলাকা দিয়েই ঢাকায় ফেরার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। মানিকগঞ্জে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিও হয়। কিন্তু পুলিশ তাকে ধরতে পারেনি। এরপর ঢাকায় পৌঁছে যখন নরসিংদীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন, পথিমধ্যে পুলিশ তাকে আটক করে। সেদিনই তার গতিময় জীবনের সমাপ্তি এবং এরপর থেকেই চার দেওয়ালের সুউচ্চ প্রাচীরঘেরা কারাগারে সবচেয়ে অন্ধকার জগতের বন্দিজীবন শুরু হয় শাহজাহান ভূঁইয়ার।
যেভাবে জল্লাদ হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটে: জীবনের সুন্দর সোনালী দিনগুলো কারাগারেই কাটাতে হবে- এমন ভাবনা থেকে শাহজাহান চিন্তা করলেন, জল্লাদ হিসেবে সময় দিলে তার সাজা কিছুদিনের জন্যে হলেও কমবে। তাই নিজেকে অন্যভাবে প্রস্তুত করার জন্য জেল সুপারের কাছে গিয়ে জল্লাদের খাতায় নাম লেখানোর আগ্রহপ্রকাশ করেন।
১৯৮৯ সালে তিনি সহযোগী জল্লাদ হিসেবে গফরগাঁওয়ের নূরুল ইসলামকে ফাঁসি দিয়ে তার জল্লাদ জীবনের নাম লেখান। এটাই তার জীবনে প্রথম কারাগারে কাউকে ফাঁসি দেওয়ার ঘটনা। এই কাজে শাহজাহানের যোগ্যতা দেখে আট বছর পর ১৯৯৭ সালে কারা কর্তৃপক্ষ তাকে প্রধান জল্লাদের স্বীকৃতি দেয়।
প্রধান জল্লাদ হওয়ার পর আলোচিত ডেইজি হত্যা মামলার আসামি হাসানকে প্রথম ফাঁসি দেন শাহজাহান। তিনি জানান, একটি ফাঁসি দিতে প্রধান জল্লাদের সঙ্গে ছয়জন সহযোগী লাগে এবং ফাঁসির রায় কার্যকর করলে প্রত্যেক জল্লাদের দুই মাস চার দিন করে কারাদণ্ড মওকুফ হয়। এছাড়া, কারাগারে যারা জল্লাদ হওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করে, কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাহজাহান তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন।
সোনালী দিনগুলো কারাগারের বন্দী খাঁচায় বিলীন করে ৭৩ বছর বয়সে নিজ পরিবারের মাঝে ফিরে আসবেন সেই পুরনো দিনের ৩৬ মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া। তার মুক্তিপ্রাপ্তির খবরে নিজ পরিবারে আনন্দের বন্যা বইছে। তবে জল্লাদ শাহজাহান ভূঁইয়া মুক্তি পেয়ে নিজ এলাকা তথা গোটা জাতিকে কী বার্তা দেবেন,নাকি পুরনো অপরাধে লিপ্ত হবেন, এমন নানান প্রশ্ন এখন সাধারণ জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।