মিরসরাইয়ে দেশের প্রথম “মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’, মনে হয় গাছের জাদুঘর
চট্টগ্রাম প্রতিনিধি:
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে তৈরি করা হয়েছে দেশের প্রথম ‘মিয়াওয়াকিফরেস্ট।’ উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় ‘প্রকল্প সোনা পাহাড়’ নামের একটি ব্যক্তি উদ্যোগের প্রকল্পে এই কৃত্রিম বন তৈরি করা হয়েছে । উদ্যোক্তারা জানান, পরীক্ষামূলকভাবে দেশের প্রথম এ কৃত্রিম বন তৈরিতে সফল হয়েছেন তারা।
সম্প্রতি সরেজমিনে ঘুরে মিরসরাইয়ের জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড় এলাকায় ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’-এ গিয়ে দেখা যায়, সবুজের সমারোহে নান্দনিক স্থাপনায় গড়ে তোলা হয়েছে প্রকল্পটি। পাহাড়ের কোলে টিলা শ্রেণির জায়গাটির ৪ হাজার ৪০০ বর্গফুট এলাকা জুড়ে সুপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে “মিয়া ওয়াকি ফরেস্ট’ । দূর থেকে দেখলে ১৩ মাস বয়সি কৃত্রিম বনটিকে মনে হয়ে যেন এক যুগ বয়সি বন । ছোট এ বনের ভেতরে ঢুকে চোখে পড়ে শত প্রজাতির গাছ আর লতা-গুল্মের সমারোহ । দেখে মনে হয়, এ যেন গাছের জাদুঘর ।
জাপানের বিখ্যাত উদ্ভিদবিদ আকিরা মিয়াওকি হচ্ছেন এই ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ ধারণার প্রবক্তা। এই পদ্ধতিতে ছোট ছোট জায়গায় অল্প সময়ে বয়স্ক বনের আদল তৈরি করা যায়। তার উদ্ভাবিত এই পদ্ধতি অনুসরণ করে মাত্র ৩০ বর্গফুটের মধ্যেও বন তৈরি করা সম্ভব । এই পদ্ধতিতে লাগানো গাছ সাধারণ বনের গাছের চেয়ে ১০ গুণ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় এবং বছরে অন্তত এক মিটার বাড়ে। মিয়াওয়াকি উদ্ভাবিত এই বন তৈরির পদ্ধতি ব্যবহার করে কোনো স্থানে ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে গভীর বন তৈরি করা সম্ভব। আর এই বনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, অন্য সাধারণ বন থেকে এই বন ৩০ গুণ বেশি কার্বন ডাইঅক্সাইড শোষণ করতে পারে। বর্তমানে আকিরা মিয়াওয়াকির এই ধারণা কাজে লাগিয়ে নেদারল্যান্ড ও ভারত তাদের দেশের বিভিন্ন জায়গায় ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ গড়ে তুলে সুফল পাচ্ছে। বাংলাদেশে মিরসরাই উপজেলার সোনাপাহাড় এলাকায় ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়ে প্রথম বারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে এই “মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ ধারণার বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
মিরসরাই উপজেলার ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’-এ মিয়া ওয়াকি ফরেষ্ট তৈরিতে পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের উদ্যোক্তা ও পরিচালক দেলোয়ার জাহান। তিনি বলেন, ‘মিরসরাই মিয়াওয়াকি ফরেস্ট তৈরিতে আমরা প্রথমে মাটি প্রস্তুত করেছি। সে মাটিতে জৈব সার হিসেবে গাছের গুঁড়ি, খড় ও লতা-পাতাপচা ব্যবহার করা হয়েছে। আলাদা জায়গায় মাটি প্রস্তুত করে সে মাটি নির্দিষ্ট জায়গায় নিচ থেকে ওপরে কিছুটা ঢালু করে বিছানো হয়েছে। তারপর সেখানে দুই বর্গফুট জায়গার চার কোণ চারটি করে গাছ লাগানো হয়েছে। এখানে ৪ হাজার ৪০০ বর্গফুট জায়গায় আমরা স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা ১২০ প্রজাতির গাছ ও লতা-গুল্ম লাগিয়েছি। তুলসী থেকে কদম, বাঁশ থেকে বেত সব ধরনের প্রজাতির সম্মেলন ঘটানো হয়েছে এই বনে। লাগানোর পর থেকে ১৩ মাস বয়সি গাছগুলোর কোনো কোনোটির উচ্চতা ৭০ ফুট পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে এখন। বলতে পারি, মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ তৈরির চেষ্টায় সফল হয়েছি আমরা।’
মিরসরাইয়ে ‘প্রকল্প সোনা পাহাড়’ প্রকল্পটির উদ্যোক্তা আমজাদ হোসেন বলেন, ‘আমরা যখন সোনাপাহাড় এলাকার এই জায়গাটির সন্ধান পাই, সেটি তখন পরিবেশ বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত ছিল। এখানে প্রতিনিয়ত পাহাড় কাটা চলত। ইটভাটার জন্য মাটি কেটে উর্বর জমিতে গভীর পুকুর তৈরি করা হতো। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় প্রাণ-প্রকৃতির যখন নাভিশ্বাস উঠছিল, আমরা তখন এখানে প্রকৃতির শুশ্রুষার দায়িত্ব নিয়েছি । এখানে আমরা প্রকৃতির কোনো ক্ষতি না করে প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য সংরক্ষিত পর্যটনের ব্যবস্থা করছি।’
মিরসরাইয়ে ‘প্রকল্প সোনাপাহাড়’ প্রকল্পে গড়ে তোলা ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ সম্পর্কে জানতে চাইলে উদ্ভিদ ও প্রকৃতিচর্চা সম্পর্কীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তরু পল্লবের প্রতিষ্ঠাতা, প্রাবন্ধিক ও উদ্ভিদবিষয়ক গবেষক মোকারম হোসেন বলেন, ‘অল্প সময়ে বন সৃষ্টির দারুণ এক পদ্ধতি ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’। আমার জানা মতে, মিরসরাইয়ের উদ্যোগটি ছাড়া এখন পর্যন্ত দেশে আর কোনো ‘মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ নেই। সরকারি ন্যাড়া পাহাড়গুলোতে আগ্রহী ব্যক্তিদের অংশীজন করে “মিয়াওয়াকি ফরেস্ট’ সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন ।’