ধানমণ্ডি লেকে গাছ কেটে পরিবেশ ধ্বংস একটি চক্রের

প্রকাশিত: ১২:৫৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ১৯, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

রাজধানীর ধানমণ্ডি লেকপারের গাছ কাটছে একটি চক্র। নিজেদের লেকের ইজারাদার দাবি করে অনেকদিন ধরে গাছ কেটে আসছে চক্রটি।

তবে নিজেদের লেকের ইজারাদার দাবি করলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) বলছে, গত ৫ আগস্টের পর আগের ইজারাদাররা উধাও হওয়ার পর থেকে এখনো কাউকে লেক দেখভালের জন্য নতুন করে ইজারা দেওয়া হয়নি। আর ইজারাদার থাকা অবস্থায়ও কাউকে কখনো লেকপারের গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়নি। অথচ গত কয়েক দিনে লেকপারের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ৩০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে।

সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ধানমণ্ডি ৮, ১০, ১২ নম্বরসহ রবীন্দ্রসরোবর এলাকায় লেকের বিভিন্ন অংশের অনেক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। গাছ কাটার পর ওইসব স্থানে এখনো ডালপালা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে। মাটির নিচে উঁকি দিচ্ছে কেটে নেওয়া গাছগুলোর মূল।

আব্দুল মতিন নামে ধানমণ্ডির একজন বাসিন্দা বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে লেকপারের গাছ কাটা হচ্ছে। এভাবে নির্বিচারে গাছ কাটা হলে শান্তির এই জায়গাটিও নষ্ট হয়ে যাবে। একটু বিশুদ্ধ বাতাসের স্পর্শ নিতে মানুষ এখানে হাঁটতে বা ঘুরতে আসে। সামনে সেটাও আর পাওয়া যাবে না।

ধানমণ্ডি সোসাইটির একজন সদস্য বলেন, ‘সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা যেখানে যেখানে জানানো দরকার জানিয়েছি। পরিবেশ-প্রকৃতি ধ্বংস করা এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অতীতের মতো এখনো আমরা সোচ্চার। নিরাপত্তাকর্মীরা জড়িত একজনকে ধরেছে। কিন্তু কিভাবে যেন ওই ব্যক্তি ছাড়া পেয়ে গেছে।

জানা যায়, মৎস্যজীবী লীগের শওকত নামের এক সদস্য গত ৯ জানুয়ারি ধানমণ্ডি লেকের ৮ থেকে ১০ নম্বর রোড, ৮ নম্বর ব্রিজ থেকে সুধাসদন, ডিঙ্গি রেস্তোরা থেকে ১২ নম্বর পর্যন্ত এবং রবীন্দ্রসরোবরের কয়েকটি স্থান থেকে বড় বড় অন্তত ৩০টি গাছ কেটে নিয়ে যান। এই কাজে তাকে সহায়তা করেন ধানমণ্ডি লেকের ইজারাদার পরিচয় দেওয়া সাইফুল, শুভ ও সাজ্জাদ।

পরে গাছ কাটার খবর পেয়ে ধানমণ্ডি সোসাইটির নিরাপত্তাকর্মীরা শওকত এবং গাছসহ ট্রাক আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। কিন্তু সহযোগী শুভর সহায়তায় শওকত গাছসহ থানা থেকে ছাড়া পান। এর আগে গত ৫ আগস্টের পর বিষ প্রয়োগে ধানমণ্ডি লেকের মাছ মারার ঘটনায়ও এই চক্রটি জড়িত ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, ট্রেড এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মোহাম্মদ শুভসহ বেশ কয়েকজন নিজেদের ধানমণ্ডি লেকের বিভিন্ন অংশের ইজারাদার দাবি করে লেকপারের গাছ কাটছেন। তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ৫ আগস্টের পর আগের ইজারাদাররা কাজ না করলেও নতুন করে এখনো কাউকে ইজারা দেওয়া হয়নি।

মোহাম্মদ শুভ বলেন, ‘আমরা পুরনো ইজারাদার না। নতুন করে সিটি করপোরেশন থেকে ইজারা নিয়েছি। অতিরিক্ত গ্যাসের কারণে আগস্ট মাসে লেকের অনেক মাছ মারা গেছে। সিটি করপোরেশনের মৌখিক অনুমতি নিয়ে আমরা লেকের ওপরে ঝুঁকে থাকা গাছের ডাল কেটে পরিষ্কার করছি; কোনো গাছ কাটছি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা যদি ইজারা না নিতাম, তাহলে রাজস্ব কিভাবে তুলছি?’

এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা (উপসচিব) কাইজার মোহাম্মদ ফারাবী বলেন, ‘আমরা নতুন করে কাউকে ইজারা দিইনি। আর ইজারা কার্যক্রম সম্পন্ন হলেও তো কাউকে গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হতো না। এটা কখনো সম্ভব নয়। যারা গাছ কাটছে, তারা মিথ্যা বলছে। বিষয়টি জানার পর আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি কারা এই কাজ করছে।’

নগর বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন পার্কের লেকগুলো ইজারা দেওয়ার ক্ষেত্রে আরো সচেতন হতে হবে। দলীয় ট্যাগ দেখে অতীতে ইজারা দেওয়া হয়েছে। এই ট্যাগ ব্যবহার করে ইজারার মূল কাজ ছেড়ে সবাই শুধু ধ্বংস করেছে। এখনো যদি এসব চলে, তা মেনে নেওয়া যায় না।’

তিনি বলেন, ‘এমনিতেই প্রাকৃতিক কারণে রাজধানীতে গাছের সংখ্যা কম। সেখানে যদি এভাবে গাছ কাটা হয় তাহলে প্রকৃতি কাউকে ছাড় দেবে না।’

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ধানমণ্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) তারেকুজ্জামান সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘কয়েক দিন আগে ধানমণ্ডি লেকপারের গাছ কেটে ট্রাকে ভরে নিয়ে যাওয়ার সময় ট্রাক ভর্তি গাছসহ একজনকে আমরা আটক করেছিলাম। পরে তারা নিজেদের লেকের ইজারাদার পরিচয় দিয়ে জানান, মাছ চাষের জন্য লেকের পানি পরিষ্কার করতে লেকে ভেঙে পড়া গাছ কেটেছেন। তখন আমরা আর কোনো গাছ কাটা হবে না—এমন মুচলেকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দিই।’

তিনি আরো বলেন, ‘পরে আমরা জানতে পারি, শুধু ভেঙে পড়া গাছ নয়, এর বাইরেও অনেক গাছ কাটা হয়েছে। আমরা সিটি করপোরেশন বা অন্য কারো কাছ থেকে লিখিত কোনো অভিযোগ পাইনি। অবৈধভাবে গাছ কাটার বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’