ডেস্ক রিপোর্ট:
আজ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান এবং এই দিনটি একইসঙ্গে ‘মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ডে’। এই দিনটি হলো, আমেরিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রতীক মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের দিন।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র একজন ঐতিহাসিক নেতা, যিনি বর্ণবৈষম্য ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। ১৯৫৫ সালে মন্টগোমারিতে বাস বয়কট আন্দোলনের সময় তার নেতৃত্ব সারা জাতির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তিনি ১৯৫৭ সালে সাদার্ন ক্রিশ্চিয়ান লিডারশিপ কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৬৩ সালের বিখ্যাত ওয়াশিংটন মার্চে নেতৃত্ব দেন। এই মার্চে তিনি তার ঐতিহাসিক ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ ভাষণ দেন, যা আজও মানবাধিকারের সংগ্রামের প্রেরণা।
‘স্বপ্ন’ সবাই দেখে। বলা হয়, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। স্বপ্ন ফেরিওয়ালাও এ পৃথিবীতে কম নেই, যাদের স্বপ্নের ফানুস একটু আকাশে উড়তে না উড়তেই ভেঙে পড়ে। তাই শুধু স্বপ্ন থাকলেই হয় না, যদি তা কল্পনাপ্রসূত হয় কিংবা দিকনির্দেশনায় অস্পষ্ট থাকে, তাহলে সেই স্বপ্ন বাস্তবতার সম্ভাবনাকে শেষ করে দেয়। তবুও যুগে যুগে কিছু মহামানবের স্বপ্ন পৃথিবীর ইতিহাসে বড় বাঁকবদল এনেছে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষ্ণাঙ্গ অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র এমনই এক স্বপ্নের কথা বলেছিলেন।
মানুষ জন্মসূত্রে স্বাধীন এবং সমান। একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়তে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি নতুন, বর্ণবিদ্বেষমুক্ত জাতির। আজ থেকে প্রায় দেড় শ বছর আগে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে দাসপ্রথার বিলোপ ঘটিয়েছিলেন। সংবিধানে বলা হয়েছিল—সবাই সমান, সবাই এক। তবে সেই স্বপ্নের চারপাশে দুঃস্বপ্নের প্রাচীর দাঁড়ায়, যা তাকে এগোতে দেয় না। ১৯৫৫ সালেও দেখা যায়, শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে বর্ণবিদ্বেষের বিষ রয়ে গেছে, যা মার্কিনসমাজে চোরাস্রোতের মতো প্রবাহিত। কৃষ্ণাঙ্গদের জন্ম, কর্ম, চলাফেরায় ছিল বর্ণবিদ্বেষের চোখরাঙানি। বাসে কৃষ্ণাঙ্গদের পশুর মতো বিবেচনা করা হতো, তাদের বসার অধিকারও ছিল না। মানবিক মর্যাদার দাবি ও অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন জোরালো হতে শুরু করে। ১৯৫৬ সালে ফেডারাল কোর্ট ঘোষণা দেয়, বাসে বর্ণভিত্তিক বিভাজনের নিয়ম অসাংবিধানিক।
শতকের পর শতক ধরে শ্বেতাঙ্গদের এই মানসিক বিকৃতির শিকার হয়েছে কোটি কোটি অশ্বেতাঙ্গ। নিজেদের মর্যাদা রক্ষায় এবং বৈষম্যের প্রতিবাদে আজ থেকে ৫০ বছর আগে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র অহিংস আন্দোলনের সূচনা করেন। সেদিন লিংকন মেমোরিয়ালে আড়াই লাখ মানুষের সামনে তিনি শুনিয়েছিলেন একটি স্বপ্নের কথা, যা হয়ে উঠেছিল শতাব্দীর সেরা মানবমুক্তির কবিতা—‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’। সেই অমর উচ্চারণ ছিল : “আমি স্বপ্ন দেখি, আমার চার সন্তান একদিন এমন একটি দেশে বাস করবে, যেখানে তাদের গায়ের রং দিয়ে নয়, তাদের চরিত্রের গুণ দিয়ে তাদের বিচার করা হবে।…এই স্বপ্ন নিয়েই আমি দক্ষিণে ফিরে যাব। এই বিশ্বাস নিয়ে হতাশার পাহাড় থেকে আমরা তৈরি করব আশার পাথর। এই বিশ্বাস নিয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করব, একসঙ্গে প্রার্থনা করব। আমরা একসঙ্গে মুক্ত হব—এই বিশ্বাস নিয়ে।’
মানুষের স্বাধীনতা, শান্তি, সুন্দর জীবন, আশা এবং স্বপ্নকে ইতিহাসের সঙ্গে একীভূত করার বিরল শক্তি নিয়ে পৃথিবীতে এসেছিলেন কিছু কিংবদন্তি নেতা। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ছিলেন তাদেরই একজন। ভালোবাসা ও অহিংসা যে কীভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী অস¿ হয়ে উঠতে পারে, তা তিনি প্রমাণ করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। তার প্রতিধ্বনি আমরা শুনি দক্ষিণ আফ্রিকায় নেলসন ম্যান্ডেলার কণ্ঠে। রক্তপাত ছাড়া যে যুদ্ধে জয়ী হওয়া সম্ভব, তা তারা দেখিয়েছেন।
মার্টিন লুথার কিংয়ের স্বপ্ন আজ এই বিশ্বকে কোথায় নিয়ে এসেছে! তার স্বপ্ন এক নিষ্ঠুর ইতিহাসের কলঙ্ক দূর করে মানবজাতিকে দিয়েছে নতুন ভবিষ্যৎ। তার সেই স্বপ্নের উচ্চতা মানবমুক্তির সমান বিশাল। যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকা থেকে আনা হয়েছিল প্রায় ৪০ লাখ দাস। সেই দেশেই দাসপ্রজন্মের সন্তান বারাক ওবামা এবং মিশেল ওবামা ইতিহাসের শীর্ষে পৌঁছুতে পেরেছেন। মার্টিন লুথার কিংরা আমাদের বলে দেয়—সভ্যতার কালিমা মুছে আলোর পথ দেখানোর ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এক অবিশ্বাস্য আশার দেশ। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র ডে আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কীভাবে একজন মানুষ নিজের দৃঢ়তা এবং আদর্শ দিয়ে একটি জাতির বিবেককে জাগিয়ে তুলতে পারেন। তার জীবন ও কাজ আমাদের শেখায় যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করাই টেকসই পরিবর্তনের পথ।