হোয়াইট হাউজে ট্রাম্প: নভেম্বরের ভোট বিপ্লবে আশার সঙ্গে আছে আতঙ্ক

প্রকাশিত: ৫:০৯ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২০, ২০২৫

ডেস্ক রিপোর্ট:

পুননির্বাচনে ২০২০ সালে হেরে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের১২০ বছরের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম সাবেক প্রেসিডেন্ট, যিনি আবার প্রেসিডেন্ট হয়ে হোয়াইট হাউজে যাচ্ছেন। সেই ট্রাম্পকে নিয়ে সবাই নার্ভাস। কারণ কেউ জানে না যে, ট্রাম্প আসলে কী করতে যাচ্ছেন। তিনি সরকার, বড় ব্যবসায়ী এবং সামরিক বাহিনীর প্রধানসহ অনেকের জন্যই আতঙ্কের কিংবা আশার সঞ্চারকারী। তার অবিশ্বাস্য ভাবে ওয়াশিংটনের কুর্সিতে ফিরে আসাটা অনেকের জন্যই অপ্রত্যাশিত। তিনি যে কারো জন্য আতঙ্কের হতে পারেন, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ব্রিটেনের লেবার পার্টির মধ্যকার প্রস্তুতিতে। বিবিসি জানিয়েছে, লেবার পার্টির সরকার গোপনে একটি মিনি ক্যাবিনেট তৈরি করেছে কেবল ট্রাম্পকে সামলানের জন্য। অথচ ব্রিটেন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যিক অংশীদার ।

ভয় নির্বাহী আদেশ নিয়ে
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ১১ মাস আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প ফক্স নিউজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তিনি এক দিনের জন্য স্বৈরশাসক হবেন । আর সেই দিনটি হতে পারে স্থানীয় সময় ২০ জানুয়ারি সোমবার শপথের দিন। তিনি এদিন থেকেই শতাধিক নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করবেন, যার অনেকগুলোকে হয়তো ট্রাম্পকে স্বৈরাচারীও আখ্যা দিতে পারে। কিন্তু নির্বাচনের আগেই দেওয়া প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। নির্বাহী আদেশের মধ্যে গুরুত্ব পেতে পারে অভিবাসীবিরোধী অভিযান, সীমান্ত নিরাপত্তা বিশেষ করে মেক্সিকো সীমান্তে আরো সৈন্য পাঠানো, ২০২১ সালে ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গার ঘটনায় জড়িতদের ক্ষমা করে দেওয়া এবং ব্রিটেনের সঙ্গে বাণিজ্য, ইউক্রেন যুদ্ধ এবং গাজা ইস্যু। এসব নির্বাহী আদেশ কংগ্রেসে পাশ করার প্রয়োজন হয় না ।

ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের আওতায় আসতে পারে মুসলিম নিষেধাজ্ঞাও। ২০১৭ সালে তিনি নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে সিরিয়া, লিবিয়া এবং ইয়েমেনসহ কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশ থেকে মুসলমানদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন।

এর বিরুদ্ধে আদালতে গেলেও শেষ পর্যন্ত তার সমাধান পাওয়া যায়নি । জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর মুসলিম দেশগুলোর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছিলেন ।

ট্রাম্প এবার সেই আদেশ আবার পুনর্বহাল করতে পারেন । মার্কিন নাগরিকত্বের ক্ষেত্রে একটা অন্যতম নিয়ম হলো, অবৈধ অভিবাসী হলেও যুক্তরাষ্ট্রে কারো সন্তানের জন্ম হলে ওই সন্তান স্বাভাবিকভাবেই নাগরিক হয়ে যাবেন । কিন্তু ট্রাম্প সেই নীতি বাতিল করতে পারেন। এছাড়া কেউ চাইলেই মা-বাবাকে নিয়ে মার্কিন নাগরিক বানাতে পারবেন না। ২০২৩ সালের মে মাসেই তিনি এমন অঙ্গীকার করেছিলেন।

আতঙ্কে যুক্তরাজ্য ও জার্মানিসহ ইউরোপ

নির্বাচনি প্রচারণার সময়ই ট্রাম্প অভিযোগ করেছিলেন যে. যুক্তরাজ্যের ক্ষমতাসীন দল লেবার পার্টির কর্মীরা ডেমোক্র্যাটপ্রার্থী কমলা হ্যারিসের পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছেন । এই প্রচারণার কথা স্বীকার করলেও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার দাবি করেছিলেন, এরা স্বেচ্ছাসেবী, সব সরকারের সময়ই তারা প্রচারণায় যুক্ত হন । এখানে সরকারের কোনো হাত নেই। কিন্তু ট্রাম্প স্টারমারের সেই কথায় আশ্বস্ত হতে পারেননি। তার জয়ের পর সম্প্রতি ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ ইলন মাস্ক (টেসলা ও এক্সের মালিক) ব্রিটিশ সরকার নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। অনেক বিশেষজ্ঞ আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, স্টারমার সরকারের পতনে কাজ করতে পারে ট্রাম্প প্রশাসন । সেই ধাক্কা সামলাতে লেবার পার্টির সরকার না কি একটি গোপন মিনি ক্যাবিনেট গঠন করেছে। একটি সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসি জানিয়েছে, এই ক্যাবিনেট ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেছে। তারা সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন দেবেন যে, কীভাবে ট্রাম্পের নীতিকে সামলানো যায় । তবে তারা এখনো চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে পারছেন না। কারণ ট্রাম্পের মতিগতি তারা বুঝতে পারছেন না । আর ট্রাম্পকে ধারণা করাও কঠিন ।

ট্রাম্প নির্বাচনে জয়ে পর জার্মান সরকারের মধ্যেও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। দেশটির কট্টরপন্থি বিরোধী দলের পক্ষে ইতিমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় স্ট্যাটাস দিয়েছেন ইলন মাস্ক । বর্তমানের উদারপন্থি সরকারের পতনে ট্রাম্প প্রশাসন কাজ করতে পারেন বলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে। ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোও কম আতঙ্কে নেই। ট্রাম্প এসব দেশকে প্রতিরক্ষা বাজেট পাঁচ গুন বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন । তিনি ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্র বেরিয়ে যেতে পারে বলেও হুমকি দিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত হওয়ার পরই ডেনমার্কের কাছ থেকে গ্রিনল্যান্ডের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়েছিলেন ট্রাম্প । আর সেই ইচ্ছে যে প্রবল, তা ক্রমশই পরিষ্কার হচ্ছে। ডেনমার্কের ওপরে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ বাড়াচ্ছেন তিনি । একইভাবে কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম প্রদেশ করা কিংবা পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার দখলে নেওয়ার ইচ্ছাও তার মধ্যে আছে।

কেবল বাইরের দেশে আতঙ্ক নয়, যুক্তরাষ্ট্রেও এর আভাস পাওয়া যাচ্ছে । গত বুধবার জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া বিদায়ি ভাষণে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, প্রচুর পরিমাণ সম্পদ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি নিয়ে একটি গোষ্ঠীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে চলছে আমেরিকায়। দেশের জন্য তথা গোটা বিশ্বের জন্য এটা বিপদ ডেকে আনতে পারে। তিনি বলেন, মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য ভূমিকা নিতে হবে সাধারণ মানুষকে। না হলে বিপজ্জনক গোষ্ঠী শাসনের পাল্লায় পড়বে আমেরিকা। ট্রাম্পের নাম উল্লেখ না করে বাইডেনের অভিযোগ, মার্কিনিদের ভুল ও মিথ্যা তথ্য দেওয়া শুরু হয়েছে। ভবিষ্যতে ক্ষমতার অপব্যবহার হবে। সংবাদমাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা থাকবে না। পাশাপাশি পরিবেশ রক্ষায়ও ইতিবাচক পদক্ষেপ আশা করা যাবে না ।

যুদ্ধ বন্ধের আশাও আছে

ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে পারেন। তিনি ২০২৩ সালের মে মাসে এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন, দায়িত্ব নেওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যে তিনি ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নেবেন। গত ১৩ জানুয়ারি ট্রাম্প জানান, শিগিরই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হবে। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠজনরা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধে চুক্তি করতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে চাপ প্রয়োগ করবেন ।

গত বুধবার ইসরাইল-হামাস যুদ্ধবিরতির পরেই নিজের ট্রুথ সোশ্যাল নেটওয়ার্কে থেকে জাতির উদ্দেশ্যে বার্তা দেন ট্রাম্প। তিনি লেখেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে বন্দিদের জন্য আমাদের চুক্তি হয়েছে। শিগগিরই তাদের মুক্তি দেওয়া হবে।’ তখন পর্যন্ত হোয়াইট হাউজ যুদ্ধবিরতির চুক্তির বিষয়ে কিছুই জানায়নি ।

এই যুদ্ধবিরতি চুক্তির জন্য কৃতিত্ব দাবি করে ট্রাম্প বলেন, ‘নভেম্বর বিপ্লবের (কংগ্রেসের উভয় কক্ষে রিপাবলিকানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে) কারণেই এই চুক্তি সম্ভব হয়েছে । এখানেই না থেমে ট্রাম্প জানান, তার প্রশাসন শান্তি ও আলোচনার মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে বার্তা দিতে চায় । উল্লেখ্য, গত ৫ নভেম্বরের নির্বাচনে কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে দ্বিতীয় বারের মতো জয় পান ট্রাম্প ।