সাইফুল ইসলাম:
সাইবার অপরাধ শুধু বাংলাদেশের জন্য নহে, সমগ্র বিশ্বের জন্যই একটি বড় সমস্যা। দ্য ইকোনমিস্টের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বার্ষিক ৯ কোটি সাইবার আক্রমণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৫৭৫ বিলিয়ন ডলার। এই জন্য সাইবার নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট ব্যবসাও দিনদিন বাড়িয়া চলিয়াছে। বিশ্বব্যাপী নারীরাই অধিক সাইবার অপরাধের শিকার। জাতিসংঘের ‘সাইবার ভায়োলেন্স এগেইনস্ট ওমেন অ্যান্ড গার্লস’ সংক্রান্ত রিপোর্ট মতে, বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী নারীদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই অনলাইনে হয়রানির শিকার। বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী (১৩ কোটির অধিক) ও ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর (৫ কোটির অধিক) সংখ্যা যতই বৃদ্ধি পাইতেছে, ততই অধিকাংশ ক্ষেত্রে সাইবার অপরাধের সহজ শিকার হইতেছে নারীরা।
বাস্তবতা হইল—ইন্টারনেট ও স্মার্টফোন ব্যবহারের মাধ্যমে নারীর শিক্ষা ও কাজের পরিধি বাড়িয়াছে বাংলাদেশে। অনেক নারী উদ্যোক্তা ফেসুবক পেইজ ও ইউটিউবের মাধ্যমে আয়-ইনকামের সহিত সংশ্লিষ্ট রহিয়াছেন; কিন্তু নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ সম্পর্কিত ভয়েসের (ভয়েস ফর ইন্টারঅ্যাকটিভ চয়েস অ্যান্ড এমপাওয়ারমেন্ট) এক সেমিনারে বক্তারা বলিয়াছেন যে, আমাদের দেশে ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে বৃদ্ধি পাইয়াছে নারীর প্রতি সহিংসতা। তাহাদের দাবি, গত সাড়ে তিন বৎসরে (২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত) সাইবার অপরাধের শিকার ৬০ হাজার ৮০৮ জন নারী প্রতিকার চাহিয়াছেন। ইহার ৪১ শতাংশই ডক্সিং, ১৮ শতাংশ ফেসবুক আইডি হ্যাক, ১৭ শতাংশ ব্ল্যাকমেইলিং, ৯ শতাংশ ইমপারসোনেশন ও ৮ শতাংশ সাইবার বুলিংয়ের শিকার। ভুক্তভোগীদের অধিকাংশই প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝিতে পারেন নাই তাহারা কী করিবেন ও কোথায় গেলে প্রতিকার পাইবেন। ভুক্তভোগী নারীরা অনেক সময় মামলা করিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাহারা তাহা তুলিয়া নিতে বাধ্য হন। কেন বাধ্য হন তাহাও বিবেচনায় আনিতে হইবে। সাইবার স্পেসে নারীদের হয়রানি প্রতিরোধকল্পে ২০২০ সালে গঠিত হইয়াছে ‘পুলিশ সাইবার সাপোর্ট ফর উইমেন’ কার্যক্রম; কিন্তু এই ব্যাপারে প্রচার-প্রচারণা অত্যন্ত কম।
কোথায়, কীভাবে ও কাহার নিকট অভিযোগ দায়ের করিতে হইবে—এই ব্যাপারে পত্রপত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যাম্পেইন চালানো দরকার। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণার প্রতিবেদন হইতে জানা যায়, প্রায় ৫২ শতাংশ অভিযোগই আসে নারীদের নিকট হইতে। সবচাইতে অধিক আক্রান্ত হইতেছেন ১৮ হইতে ৩০ বৎসর বয়সি মেয়েরা। শতাংশের হিসাবে যাহা প্রায় ৭৪ শতাংশ। যাহার মধ্যে সুপার ইম্পোজ ছবি ও পর্নোগ্রাফির মতো ভয়াবহ অভিযোগও রহিয়াছে। তাই বিষয়টিকে অবহেলা করিবার অবকাশ নাই।
সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সরকারের সঠিক মনিটরিংয়ের পাশাপাশি পিতা-মাতা ও অভিভাবকদের সচেতন ভূমিকা একান্ত প্রত্যাশিত। অভিযোগ দায়েরের জন্য ফোনালাপের রেকর্ড, মেসেজের স্ক্রিনশট, বিভিন্ন আলামতের স্ক্রিনশট, লিংক, অডিও বা ভিডিও ফাইল সংগ্রহে রাখা দরকার। এই ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়িয়া তুলিবার পাশাপাশি নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও বদলানো প্রয়োজন। আইসিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী কাহারো অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও তোলা এবং তাহা প্রকাশ করিবার অপরাধে ১০ বৎসর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১০ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড দেওয়ার বিধান রাখা হইয়াছে। এই আইনের সঠিক ব্যবহার হইলে সাইবার অপরাধ অনেকাংশে কমিয়া যাইবে।
ইহা ছাড়া আইসিটি বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্ক কিংবা সরকারি হেল্পলাইন (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) ও হটলাইনে (৯৯৯) যোগাযোগ করিতে হইবে। সিআইডি, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, পিবিআই ও র্যাবের সাইবার অপরাধ তদন্তবিষয়ক সেলের শরণাপন্ন হইতে হইবে। আমাদের বক্তব্য হইল—সাইবার অপরাধ প্রতিরোধে এই সকল সরকারি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে মানুষকে জানাইতে হইবে। এই সংক্রান্ত অপরাধের তদন্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ সাইবার জগতে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে গবেষণা, মোবাইল অ্যাপস তৈরি, গাইডলাইন প্রণয়ন, ডিজিটাল লিটারিসি বৃদ্ধিসহ যে আট দফা সুপারিশ করিয়াছে—তাহারও বাস্তবায়ন জরুরি।