ঝালকাঠিতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই চলছে বিচার কাজ

প্রকাশিত: ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ, জানুয়ারি ২৩, ২০২৫

ঝালকাঠি প্রতিনিধি:

দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে ৯০ দশকে নির্মিত ঝালকাঠি জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি। এতে চরম ঝুঁকি নিয়ে চলছে আদালতের কার্যক্রম। আর ভোগান্তি ও আতঙ্কে দিন কাটছে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী এবং আদালতে কর্মরতদের।

সংশ্লিষ্ট উচ্চপদস্থদের অবগত করে ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগ ২০১৯ সালে চিঠি চালাচালি করলেও পাঁচ বছর পেরিয়ে গেলেও বিষয়টি এখনো তা ফাইলবন্দি হয়ে আছে। দুর্ঘটনা এড়াতে আজো বড় কোনো ভূমিকা নেয়নি গণপূর্ত বিভাগ। ভবনটি দ্রুত সময়ের মধ্যে টেকসই সংস্কার অথবা পুনর্র্নিমাণের দাবি এখানকার আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও আদালত সংশ্লিষ্ট সকলের।

জানা যায়, ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগ ২০১৯ সালের ৩০ অক্টোবর জরাজীর্ণ জেলা ও দায়রা জজ আদালত ভবনটি সরেজমিনে পরিদর্শন করে চার দিন পর ৫ নভেম্বর বরিশাল তত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বরাবরে পরিদর্শন প্রতিবেদন পাঠিয়েছে। ভবন পরিদর্শনকালে তিনজন উপ-সহকারী প্রকৌশলী গণপূর্তের ঝালকাঠির নির্বাহী প্রকৌশলী এবং ঝালকাঠির বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ উপস্থিত ছিলেন। ঐ প্রতিবেদনের একটি কপি সংগ্রহ করেছে দৈনিক ইত্তেফাক।

ঝালকাঠি গণপূর্তের উপ-সহকারী প্রকৌশলী অনিরুদ্ধ মণ্ডল, মো. বদরুজ্জামান, মো. ইমরান বিন কালাম এবং নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ আল-মাসুম স্বাক্ষরিত ঐ পরিদর্শন কপিতে উল্লেখ করা হয় যে, ‘ভবনটির দুই তলায় করিডোরের বেশ কিছু স্থানে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়ছে। এছাড়াও নলছিটি কোর্ট রুমের পরিদর্শনকারীদের বসার উপরের ছাদের অংশ খসে পড়েছে। এ সমস্ত স্থানে মরিচা পড়ে রড উন্মুক্ত হয়ে আছে। দ্বিতীয় তলা এবং নিচতলার করিডোরের বেশ কিছু বীম ও কলামে ফাটল লক্ষ্য করা গেছে। ভবনটির নিচ তলায় হাজতখানার ছাদের বেশ কিছু অংশসহ করিডোরের বিভিন্ন অংশে ছাদের কনক্রিট স্প্যানিং হয়ে খসে পড়েছে। এসব স্থানেও মরিচা পড়ে রড বের হয়ে আছে। নিচ তলার বিভিন্ন কলাম এবং বীমের ফাটল লক্ষ্য করা গেছে। কিছু স্থানে কলাম ফেটে রড বের হয়ে গেছে।’

পরিদর্শন প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়, ‘ভবনটি ২য় তলা পর্যন্ত ১৯৮৯-৯০ সালে নির্মাণ করা হয়েছে। পরবর্তীকালে ২০০৪-০৫ সালে তৃতীয় তলার ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন স্থানে বীম কলামে ফাটল থাকায় এবং ছাদের কনক্রিট খসে পড়ায় বিজ্ঞ অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এমতাবস্থায়, উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট গণপূর্ত ডিজাইন বিভাগের মতামতসহ পরবর্তী প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রয়োজন।’

সম্প্রতি জজ আদালত ভবনটি ঘুরে দেখা যায় ভবনের ছাদের ওপর থেকে খসে খসে পড়ছে পলেস্তারা। ফাটল ধরেছে অনেক পিলারেও। ভারিবৃষ্টি এলেই ছাদ ও দেয়াল চুষে পানি পড়ে মেঝেতে। নষ্ট হয়ে যায় প্রয়োজনীয় নথিপত্র। দীর্ঘদিনেও টেকসই সংস্কার না হওয়ায় তিনতলা বিশিষ্ট এই ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। বিচারকের এজলাস, খাসকামরা, পেশকার-সেরেস্তাদার কক্ষ, নকল কক্ষ, হাজত খানাসহ প্রতিটি কক্ষই এখন ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যেই চলছে আদালতের কার্যক্রম। এতে যে কোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

আব্দুর রহমান, তৈয়ব আলী, কামরুল ইসলাম মুরাদ হোসেনসহ অনেক বিচারপ্রার্থীরা বলেন, ‘আদালত ভবনের ভিতরে প্রবেশের পর কাজ সম্পাদন করে বের হওয়া পর্যন্ত তারা থাকেন আতংকে। প্রায় সময়ই ছাদের পলেস্তারা খসে নিচে পরে। বর্ষায় তো বারান্দায় পানি জমেযায়। দেয়ালে পানি চুষে অনেক ফাইল নষ্ট হয়ে যায়।’

আইনজীবী মানিক আচার্য্য বলেন, ‘ভবনটি ধীরে ধীরে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও তার সংস্কার করছে না কর্তৃপক্ষ। বিচারকরা যদি ভালো পরিবেশে বিচারকার্য পরিচালনা করতে না পারে, তাহলে বিচারকার্যে মনোনিবেশও করতে পারেননা। ঝালকাঠির বিচার প্রার্থী, আইনজীবীসহ সকলেই আমরা এই ভোগান্তিতে রয়েছি। বিভিন্ন সময়ে উচ্চপদস্থদের বিষয়টি অবগত করলেও এখনো কোনো ভূমিকা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।’

আদালতের এপিপি অ্যাডভোকেট ফয়সাল হোসেন জানান, ‘ডেমেজ ভবনে দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিচারিক কার্যক্রম। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে। আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা এবং নতুন ভবন নির্মাণ অথবা টেকসই সংস্কারের জন্য গণপূর্তের চিঠি চালাচালি হলেও দীর্ঘ দিনেও কোনো ব্যবস্থা নেয়ার খবর পাইনি। জনস্বার্থে দ্রুত নতুন আদালত ভবন নির্মাণ জরুরি।’

আইনজীবী আককাস সিকদার বলেন, ‘বর্তমানে এ আদালতে ১৬ হাজার দেওয়ানী মামলা এবং দের হাজার ফৌজদারি মামলা চলমান রয়েছে। ইতোপূর্বে জরাজীর্ণ আদালত ভবনের ছাদের ও দেয়ালের আস্তর খসে অনেকের ওপর পড়েছে। আদালত ভবনের নিচতলায় হাজতখানার পশ্চিম দিকে মসজিদের সামনে একাধিকবার ধসে পড়েছে ছাদের অংশ।’ এখন এই ভবন অস্থায়ী সংস্কার না করে এটি ভেঙে এখানে নতুন ভবন করা উচিৎ বলে মনে করেন এই আইনজীবী।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘নব্বই দশকে দোতলা জজ আদালত ভবনটি নির্মাণের পর ২০০৬ সালে এর উপর আরও একতলা বর্ধিত করে তৃতীয় তলায় উন্নীত করা হয়। বর্তমানে নীচতলার অনেক পিলারে ফাটল ধরেছে। ভবনটি জরাজীর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় আদালতের স্টাফ, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা রয়েছেন আতঙ্কে। হাজতখানা সরিয়ে পার্শ্ববর্তী চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনে নেওয়া হয়েছে। ভবনে আগতদের নিরাপত্তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়। দ্রুত এটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণ এখন সময়ের দাবী।’

ঝালকাঠি গণপূর্ত বিভাগের সাবেক নির্বাহী প্রকৌশলী মো. ফয়সাল আলম এবং বর্তমান নির্বাহী প্রকৌশলী আমানুল্লাহ সরকার বলেন, ‘ভবন পরিদর্শনের রিপোর্ট ২০১৯ সনে দেয়া হয়েছে। পরবর্তীতে নতুন ভবনের জন্য সম্ভাব্য বাজেট তৈরি করা হয়েছে, যা বর্তমানে আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। সেখান থেকে অর্ডার হলেই গণপূর্ত বিভাগ টেন্ডার প্রক্রিয়াসহ অন্যান্য কার্যসম্পাদন করবে।’