অনন্য অমর একুশে গ্রন্থমেলা

প্রকাশিত: ১১:২৩ পূর্বাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক:

বইমেলা এখন আমাদের অনিবার্য বাস্তবতা। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ আর তার সন্নিহিত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ প্রান্ত জুড়ে চলে এই মেলা। বইমেলাকে বলা হয় আমাদের প্রাণের মেলা। সবাই মেনে নিয়েছি এই অভিধা। আমরা জানি, এ কেবল বিকিকিনির মেলা নয়, লেখক-পাঠক-প্রকাশক-ক্রেতা-বিক্রেতার মিলনমেলা।

বাঙালির মহান সাংস্কৃতিক উৎসব হলেও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, আমাদের প্রায় সব বইয়ের প্রকাশনা হয় বইমেলাকেন্দ্রিক। মেলার পরে মার্চ মাসে কিংবা বছরের মাঝখানে জুন মাসে লেখকের কোনো পাণ্ডুলিলিপি হাতে পেলেও প্রকাশকরা সেটি সেই ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেন, আবার ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পাণ্ডুলিপি পেলেও তা ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশ করেন। এর একটা ইতিবাচক দিক হলো এতে উৎসবমুখরতা থাকে।

অন্যদিকে নেতিবাচক দিক হলো, বের হওয়া বইয়ে যতেœর ছাপ কম থাকে। তাই ভালো-মন্দ মিলিয়ে প্রায় ৫ হাজার বই প্রকাশ হয় এই মেলাতেই। ১৬ কোটির মানুষের দেশে এই সংখ্যা কম নয়। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয় হলো, বেশিরভাগ বইই ছাপা হয় একশ থেকে তিনশ কপি। হাজার হাজার বইয়ের মধ্যে মানসম্পন্ন বইয়ের সংখ্যা বড়জোর তিনশ থেকে পাঁচশ। কোনো গবেষণা কিংবা পরিসংখ্যান নয়, এই ধারণা আমার একান্তই ব্যক্তিগত। প্রতিবছর মেলায় ঘোরার অভিজ্ঞতা থেকে আমার এই ধারণা। তবে আমার ধারণা বাতিল হলে কিংবা মিথ্যা প্রমাণিত হলেই খুশি হবো।প্রযুক্তি সহজ হয়ে যাওয়ার কারণে অনেক সময় লেখকরাই কম্পোজ করে প্রুফ দেখে প্রকাশকের হাতে দেন। আর প্রকাশকও তা হুবহু ছাপিয়ে দেন। দেখা যায় ছাপার পর প্রচুর ভুলত্রুটি থেকে যায়। এতে করে পেশাদারিত্ব থাকে না। একজন লেখক যে, সবসময় বানান বিষয়ে মনোযোগী হবেন, তা নাও হতে পারে; এটা দোষেরও কিছু নয়।

লেখক কিংবা প্রকাশক, যাকেই দায়ী করি না কেন শেষমেশ ভালোমানের বই পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে কিন্তু পাঠকরা। তারা শুদ্ধ বইয়ের পাশাপাশি অশুদ্ধ বইও পাচ্ছে। এখন মুদ্রিত অক্ষরের প্রতি বিশ্বাস থেকে পাঠক তো অশুদ্ধ বইটিকেও শুদ্ধ মনে করতে পারে। আর আমাদের পাঠকেরা এভাবেই ঠকে যেতে পারে। কিন্তু পাঠক, লেখক, প্রকাশক কেউই এই দিককার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি না, কোনো এক অজ্ঞাত কারণে।

 

প্রতি বছর মেলায় মানুষের ভিড় বাড়ছে। আগের বছরের তুলনায় এবছর ভিড় আরও বাড়বে। এটি ইতিবাচক দিক। সবাই যে মেলা থেকে বই কিনবে, এমন প্রত্যাশা আমি করি না। বই দেখুক, বই সম্পর্কে ধারণা নিক…

আমি বাংলা একাডেমির এই বইমেলায় আছি ৪০ বছর ধরে। এই ৪০ বছরে একটি দিনও বাদ যায়নি বইমেলায় উপস্থিত হওয়া থেকে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে কেবলই পাঠক কিংবা ক্রেতা হিসেবে উপস্থিত হয়েছি বইমেলায়। কেবল বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণ জুড়েই ছিল এর অবস্থান। প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে সামনের রাস্তায় ছড়িয়ে গেল এই মেলা। তারপর মেলার বিস্তার ঘটে সামনের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এই মেলাতেই আমি পাঠক থেকে লেখক হলাম। পাঠক পরিচয় তো কখনো ঘোচানো যাবে না। মেলায় আমি পাঠক ও লেখক যুগপৎ। প্রায় একযুগ ধরে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠানের কর্মী হিসেবে যুক্ত।

মেলায় হাজার বইয়ের মধ্যে পাঠক ভালো বই খুঁজে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। তখন তারা গণমাধ্যমের সহযোগিতা নেয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো, গণমাধ্যমে কেবল জনপ্রিয় লেখক-প্রকাশকদের প্রাধান্য দিয়ে প্রচারণা করেন। ফলে এমন অনেক লেখক আছেন, যারা ভালো লেখেন কিন্তু গণমাধ্যমে তাদের নিয়ে তেমন প্রচারণা হয় না বলে পাঠক তাদের বই সম্পর্কে জানতে পারেন না।গণমাধ্যম তার জনচাহিদার দিকে অবশ্যই খেয়াল রাখবেন, কিন্তু তার ভোক্তাদের নতুন খবর দেওয়ার প্রতিও তো নজর দিতে পারে—আমার প্রত্যাশা এরকম। প্রতি বছর মেলায় মানুষের ভিড় বাড়ছে। আগের বছরের তুলনায় এবছর ভিড় আরও বাড়বে। এটি ইতিবাচক দিক। সবাই যে মেলা থেকে বই কিনবে, এমন প্রত্যাশা আমি করি না। বই দেখুক, বই সম্পর্কে ধারণা নিক। স্টল থেকে না কিনুক, অনলাইন ক্রয়মাধ্যম তো আছে।

পাঠক যদি প্রতি স্টলে স্টলে ঘুরে বই নাড়াচাড়া করে দেখে, তবে অন্তত পাঁচটি বই তার পছন্দ হবেই বলে আমার বিশ্বাস। এর মধ্যে সে দুটি বই কিনবে। আর বাকিগুলো মেলায় না কিনলেও পরে ঠিকই কিনবে। তাই মেলায় ঘুরে ঘুরে বই দেখাকেও আমি ইতিবাচক মনে করি।

শিশুরা যাতে অন্য স্টলে গিয়েও তাদের উপযোগী বই সংগ্রহ করতে পারে, সে ব্যাপারে এবার খেয়াল রাখা হয়েছে সজ্জার বিষয়ে। অভিভাবকরা সে সম্পর্কে মনোযোগী হলে শিশুদেরই লাভ। শিশুদের উপযোগী বই প্রচুর প্রকাশিত হয়। শিশুদের জন্য আলাদা করে লেখার ব্যাপারটা আমাদের এখানে খুব বেশি নয়। যারাই শিশুদের জন্য লিখেছেন, তারা বড়দের জন্যও লিখেছেন। তবে শিশুদের জন্য, ওদের মন বুঝে লেখা, ওদের মতো করে সহজ-সরল ভাষায় লেখা অনেক কষ্টের। সেই পরিশ্রম খুব বেশি কেউ করছে বলে মনে হয় না।

বইমেলায় যারা আসেন তাদের স্টল খুঁজে পেতে হিমশিম খেতে হয়। কিন্তু প্রযুক্তির সহায়তায় স্টল খুঁজে পাওয়া তো খুবই সহজ বিষয়। বাংলা একাডেমির িি.িনধ২১নড়ড়শভধরৎ.পড়স নামে ওয়েবসাইট আছে। যে কেউ মোবাইল ব্যবহার করে ওয়েবসাইটে ঢুকে তার কাঙ্ক্ষিত স্টল অতি সহজেই খুঁজে পেতে পারে। আর মেলার যেকোনো গেট দিয়ে ঢুকতেই মিডিয়া সেন্টার আছে, সেখান থেকেই স্টলের অবস্থান জেনে নিতে পারবেন সহজেই। তাই ভিড়ের মাঝে কাঙ্ক্ষিত স্টল খুঁজে না পাওয়া আশঙ্কা নেই।

একটি বই যে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে, তার প্রমাণ যেমন থাকে গ্রন্থাগারে, তেমনি থাকে বহমান উন্মুক্ত বইমেলায়।

শুরুতেই বলার চেষ্টা করেছি যে বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনার ধারা আমার পছন্দ নয়। তবু কি তা এড়ানো যায়? প্রকাশকদের তাগিদ থাকে। লেখক হিসেবে কেউই তা ফেরাতে পারেন না।

প্রতিবছরের মতো সরকার প্রধান হিসেবে এই মেলা উদ্বোধন করছেন অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে মেলা উদ্বোধনের ধারাবাহিকতা থাকছে, এটি নিঃসন্দেহে আনন্দের বিষয়। মেলায় এবার স্টলের সংখ্যা বেড়েছে। ২০২৪ সালের তুলনায় এবারে নতুন বইয়ের সংখ্যাও বাড়বে।

আমাদের সৃজনশীলতার উৎকর্ষকে ধারণ করে যে বই, এই উৎসব তারই। আশা করি, এবারের সাহিত্যে নতুন প্রজন্মের চিন্তার প্রকাশও ঘটবে। একটি বই যে অতীত ও বর্তমানের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে, তার প্রমাণ যেমন থাকে গ্রন্থাগারে, তেমনি থাকে বহমান উন্মুক্ত বইমেলায়।

বইমেলায় প্রকাশিত বই-ই তো ঢুকে যায় ব্যক্তিগত গ্রন্থাগার কিংবা জাতীয় গ্রন্থাগারে। এভাবেই রচিত, রক্ষিত ও বিকশিত হয়ে থাকে যেকোনো দেশের জাতীয় সাহিত্য ঐতিহ্য। বাংলাদেশ নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নয়।