আমরা কি নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া থাকিতে পারিব?

প্রকাশিত: ৪:৩৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৪, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

পরিবেশ লইয়া একটি বিখ্যাত মার্কিন প্রবাদ রহিয়াছে, যেইখানে বলা হইয়াছে, ‘যেই দিন সর্বশেষ গাছটি কাটিয়া ফেলা হইবে, সর্বশেষ নদীটি বিষাক্ত হইয়া যাইবে, বিষাক্ত বায়ু-পানির কারণে সর্বশেষ মাছ-মুরগি মারা যাইবে, সেই দিন আমরা বুঝিতে পারিব যে, টাকা খাইয়া বাঁচিয়া থাকা যায় না।’

সাম্প্রতিক সময়ে প্রকৃতি নানাভাবে আমাদের সতর্কবাণী দিতেছে, অতি দ্রুত পরিবেশ সুরক্ষায় পদক্ষেপ না লইলে সেই দিন আসিতে অধিক সময় লাগিবে না। ফুসফুসে বিষ প্রবেশ করিতেছে; কিন্তু আমরা তো নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া থাকিতে পারিব না। ইহা সত্য যে, আমাদের জন্য অবকাঠামো, অর্থনীতি, প্রযুক্তি-সকল কিছুই দরকার; কিন্তু ইহা পরিবেশের ক্ষতি করিয়া নহে। নিঃশ্বাস বন্ধ করিয়া যেমন অর্থ গণনা করা যায় না, তেমনি বর্তমান বাস্তবতায় অর্থ ছাড়াও স্বাভাবিক জীবন যাপন করা দায়। তাই আমাদের সুন্দর ও সাবলীল জীবনের জন্য অর্থনীতি ও পরিবেশ-দুইটিকেই সমান গুরুত্ব দিতে হইবে। একটিকে আরেকটির চাইতে বড় করিয়া দেখিবার উপায় নাই: কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের অর্থনীতি বেগবান করিতে অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন এমনভাবে আগাইতেছে, যেন পরিবেশের গুরুত্বই নাই। অথচ আমরা সকলেই জানি, শেষ পর্যন্ত ইহার মূল্য আমাদেরকেই চুকাইতে হইবে।

বর্তমানে ঢাকার রাস্তায় বাহির হইলে মনে হয়, এই শহরের বায়ুমণ্ডলে কোনো বিশুদ্ধতা অবশিষ্ট নাই। ধুলাবালির কারণে রাস্তার পাশের গাছপালা, এমনকি বাসাবাড়ির বিছানা ও মেঝের উপর ধুলার স্তর জমিয়া যায়। প্রাণ ভরিয়া নিঃশ্বাস লইলে শ্বাসনালিতে ধুলা অনুভব করা যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, বায়ুদূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতি বৎসর লক্ষাধিক মানুষ শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস ও দীর্ঘমেয়াদি ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হইতেছে।

নগরায়ণ যদি সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী হইত, তাহা হইলে হয়তো আজকে পরিস্থিতি এত তীব্র হইত না। আজকের ঢাকায় যেইখানে প্রতিদিন নূতন ভবন, সড়ক ও অবকাঠামো তৈরি হইতেছে, সেইখানে পরিবেশগত ব্যাপার প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। নির্মাণকাজের সময় ধুলাবালি নিয়ন্ত্রণে যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় ইট, বালি ও কংক্রিটের টুকরা বাতাসে মিলাইয়া যায়। উন্নত দেশের নগরায়ণে নির্মাণকাজের সময় ধুলাবালি ও ধোঁয়ার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে যেই অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও কঠোর নিয়মনীতি রহিয়াছে, ঢাকায় তাহার কোনোটাই নাই। ইহার পাশাপাশি প্রতিদিন লক্ষাধিক পুরাতন ও আনফিট যানবাহন হইতে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাইঅক্সাইড গ্যাস বায়ুকে ধীরে ধীরে বিষাক্ত করিয়া তুলিতেছে। এই শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সিস্টেমের অসংগতি এবং আবর্জনা পোড়াইবার অনিয়ন্ত্রিত অভ্যাস বায়ুদূষণের সহিত দূষিত করিতেছে মাটি ও পানিকেও।

বিশ্বের উন্নত দেশসমূহ দীর্ঘদিন ধরিয়া বায়ুদূষণের সমস্যা মোকাবিলায় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছে। উদাহরণস্বরূপ, চীন একসময় ছিল বিশ্বের সবচাইতে দূষিত দেশের মধ্যে অন্যতম; কিন্তু সেইখানে কঠোর পরিবেশ নীতি, নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করিয়া বায়ুদূষণের মাত্রা উল্লেখযোগ্যভাবে কমাইয়া আনা হইয়াছে। জার্মানি ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশসমূহে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির প্রসার ঘটানো হইয়াছে। এই সকল দেশে নির্মাণকাজের সময় ধুলা ও ধোঁয়ার নিঃসারণ নিয়ন্ত্রণে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যাহা ঢাকায় নগরায়ণের ক্ষেত্রে খুবই প্রয়োজনীয়। কলকারখানার নির্গমন নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ, যানবাহনের আধুনিকায়ন ও নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ, নির্মাণকাজের সময় ধুলাবলি কমানোর জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার ও সবুজায়ন কর্মসূচির প্রসারের মাধ্যমে আমাদের দেশে বায়ুদূষণের মাত্রা ব্যাপক হারে কমাইয়া আনা সম্ভব।

পরিবেশের প্রতি দায়িত্ব শুধু সরকার বা বড় প্রতিষ্ঠানের উপর নির্ভর করে না; প্রত্যেক নাগরিকেরও এখানে অংশগ্রহণ অপরিহার্য। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সমন্বয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা প্রচারণা চালানো যাইতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতি সমাধানের জন্য আমাদের সরকার, শিল্পক্ষেত্র, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্রে কাজ করা দরকার। মনে রাখিতে হইবে, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি উদাসীনতা আমাদের অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি।