যুক্তরাষ্ট্র আমদানি কমালেও পোশাক রফতানিতে দাপট বাংলাদেশের
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি
নিজস্ব প্রতিবেদক:
আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে মার্কিন ভিসা নীতিসহ বিভিন্ন ইস্যুতে চলছে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা। তবে এসবের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিই আছে আলোচনার কেন্দ্রে। এই যখন পরিস্থিতি, ঠিক তখনই বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক আমদানি কমানোর খবর। বিষয়টিকে নানাভাবে ব্যাখ্যা করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টা করছে কোনো কোনো মহল। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবরও প্রচার করছে কিছু গণমাধ্যম।
বিভিন্ন মহল থেকে দাবি করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র আমদানি কমানোয় তা বাংলাদেশের পোশাক রফতানি খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আমদানি কমালেও এর বিপরীতে অন্যান্য দেশে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি যে বেড়েছে, সে তথ্য এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে সুকৌশলে।
সার্বিকভাবে গত বছরের তুলনায় এ বছর পোশাক রফতানি বেড়েছে বাংলাদেশের। কিন্তু এ তথ্য আড়াল করে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের মতো সংবাদমাধ্যমে তুলে ধরা হচ্ছে শুধু নেতিবাচক অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি কমানোর দিকটি। পরোক্ষভাবে তারা যেন এটিই দেখানোর চেষ্টা করছে যে, ভিসা নীতির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর বার্তার কারণেই যুক্তরাষ্ট্র পোশাক আমদানি কমিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পোশাক রফতানি কমে যাওয়ার পেছনে মার্কিন কোনো নীতির বিরূপ প্রভাব নেই। কারণ, শক্তিমত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের চেয়ে ভালো বিকল্প নেই যুক্তরাষ্ট্রের সামনে। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, মূলস্ফীতির চাপে থাকা মার্কিন বাজারে রফতানি কমে যাওয়াকে রাজনীতি দিয়ে ব্যাখ্যা করার কোনো সুযোগ নেই।
অর্থনীতিবিদ ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বর্তমানে আমাদের যে রাজনৈতিক সমীকরণ, এটার সঙ্গে দেশটিতে পোশাক রফতানি কমে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের দেশে আমদানি কমেছে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ার কারণে।’
বিকেএমইএ-র নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নিয়ে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যে ভিসা নীতি করেছে সেটা তাদের ব্যাপার। কিন্তু পোশাক রফতানির সঙ্গে এখানে কোনো রাজনীতি নেই, আগেও ছিল না আর সামনেও থাকবে না বলে আমরা বিশ্বাস করি।’
তিনি আরও বলেন, পোশাক রফতানি এখন যেটা কমেছে, সেটা সবারই কমেছে। এই পরিস্থিতি সামনে হয়তো থাকবে না, রফতানি বাড়বে। কারণ, চীনের সঙ্গে তাদের (যুক্তরাষ্ট্র) একটি বাণিজ্যযুদ্ধ চলছে। এর কিছু প্রভাব আবার ভিয়েতনামের ওপরও পড়েছে। ফলে বাংলাদেশ ছাড়া তো তাদের সামনে বিকল্প কিছু নেই।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হওয়ায় এ নিয়ে আলোচনা বেশি। কিন্তু শুধুই কি বাংলাদেশ থেকে আমদানি কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র? চলতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকেই তৈরি পোশাক আমদানি কমিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশ ছাড়াও এ তালিকায় রয়েছে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়ার মতো পোশাক রফতানিকারক দেশ।
মূলত রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরই দ্রুত বাড়তে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি। এর ফলে নিত্যপণ্য ও জ্বালানি ছাড়া অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দেন দেশটির ভোক্তারা, যার প্রভাব পড়ে দেশটির পোশাক আমদানিতে।
এ বিষয়ে বিজিএমইএ-র সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘আসলে বৈশ্বিক মন্দার জন্যই তারা আমদানি কম করছে। বৈশ্বিকভাবেই অর্ডার অনেক কম। কিন্তু তার মধ্যেও রফতানিতে আমরা ভালো করছি।’
বাংলাদেশের পোশাক রফতানির চিত্র
চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে মাসে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানি বেড়েছে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোশাক রফতানির পরিমাণ বেড়েছে। এ সময়ে পোশাক রফতানি হয়েছে ৪২ হাজার ৬৩০ দশমিক ৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩৮ হাজার ৫২১ দশমিক ১৬ মিলিয়ন ডলার। রফতানি বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
পোশাক রফতানির এই প্রবৃদ্ধিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে মাসে ইইউতে দেশের পোশাক রফতানি ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেড়েছে। রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ২২৩ দশমিক ০৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ১৯ হাজার ৩০৩ দশমিক ৬০ মিলিয়ন ডলার।
এর মধ্যে ফ্রান্স ও ইতালিতে পোশাক রফতানি যথাক্রমে ২ হাজার ৬৬২ দশমিক ৯২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ২ হাজার ৬০ দশমিক ৯৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। রফতানি প্রবৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ ও ৪৪ দশমিক ৮১ শতাংশ।
তবে রফতানি কমেছে জার্মানিতে। দেশটিতে পোশাক রফতানি কমেছে ৭ দশমিক ২২ শতাংশ। রফতানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৩৬ দশমিক ১৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৫০৫ দশমিক ৮৪ মিলিয়ন ডলার।
এদিকে যুক্তরাজ্যের বাজারে চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানি হয়েছে ৪ হাজার ৫৯২ দশমিক ৯৮ মিলিয়ন ডলার, যা বিশ্বে বাংলাদেশ থেকে পোশাক রফতানির ১০ দশমিক ৭৭ শতাংশ। আর আগের অর্থবছর একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৪ হাজার ৯৪ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার। রফতানি বেড়েছে ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ।
ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে পোশাক রফতানির ক্ষেত্রে। যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি কমেছে ৫ দশমিক ০৭ শতাংশ। অর্থবছরের প্রথম ১১ মাসে পোশাক রফতানি হয়েছে ৭ হাজার ৭৩৩ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছর একই সময়ে রফতানি হয়েছিল ৮ হাজার ১৪৬ দশমিক ৬৯ মিলিয়ন ডলার। এদিকে রফতানি বেড়েছে কানাডায়। দেশটিতে রফতানির পরিমাণ ১৭ দশমিক ৬২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৩৯০ দশমিক ৯৬ মিলিয়ন ডলার।
অন্যদিকে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে অপ্রচলিত বাজারে রফতানি ৫ হাজার ৭৯৩ দশমিক ৪৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে বেড়ে ৭ হাজার ৬৮৯ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩২ দশমিক ৭৪ শতাংশ।
কী আছে মার্কিন ভিসা নীতিতে?
গেল ২৪ মে মধ্যরাতে বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন এক বিবৃতিতে জানান, বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে সহায়তার জন্য নতুন এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে।
ব্লিঙ্কেন প্রথমে টুইট করে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। পরে এ বিষয়ে বিস্তারিত বিবৃতি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে।
এর পরই অনেকে সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যমে নিজেদের মতো করে মার্কিন এই ভিসা নীতির ব্যাখ্যা করেন। এতে জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
এ নীতি অনুসারে, বাংলাদেশে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধার সৃষ্টি করলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ভিসা দেবে না। সরকারদলীয় হোক কিংবা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, সরকারি কর্মচারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বিচার বিভাগ ইত্যাদি; অর্থাৎ নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী যিনিই হোন না কেন, তিনি মার্কিন ভিসা পাবেন না। এমনকি তাদের অর্থাৎ বিঘ্ন সৃষ্টিকারীদের পরিবারের সদস্যরাও এর আওতাভুক্ত হবেন।
সব দেশেরই নিজস্ব ভিসা নীতি থাকে, প্রয়োজনে যা পরিবর্তন করাও স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ। কিন্তু সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের নাগরিকদের জন্য ভিসা নীতি করা হলে তা হয় প্রশ্নবিদ্ধ, যা হয়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও।
ভিসা নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাখ্যা
নতুন মার্কিন ভিসা নীতি সবার জন্য প্রযোজ্য উল্লেখ করে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেছেন, এটি বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য সবাইকে উৎসাহিত করবে।
সম্প্রতি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নতুন ভিসা নীতির পেছনে ধারণাটি হলো: এটি প্রত্যেকের জন্য প্রযোজ্য। এর উদ্দেশ্য সঠিক আচরণ এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনকে উৎসাহিত করা। তাই যারা অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনকে সমর্থন করেন, তাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
পিটার হাস আরও বলেন, ‘বাংলাদেশ সরকার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রও তা-ই চায়। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তার প্রতিশ্রুতি স্পষ্ট করেছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের নির্বাচন দেখার জন্য স্বাগত জানিয়েছেন। সুতরাং, আমি কোনো মতবিরোধ দেখছি না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের আহ্বানের পরিপ্রেক্ষিতে এবং বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে বলেও জানান মার্কিন রাষ্ট্রদূত।
যা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী
ভিসা নীতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কে আমাদের ভিসা দেবে না, আর কে নিষেধাজ্ঞা দেবে–সেটা নিয়ে মাথাব্যথা করে কোনো লাভ নেই।’
সম্প্রতি তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘২০ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে, আটলান্টিক পার হয়ে আমেরিকায় না গেলে কিচ্ছু আসে যায় না। পৃথিবীতে আরও অনেক মহাসাগর আছে, অনেক মহাদেশ আছে। সেই মহাদেশের সঙ্গেই বন্ধুত্ব করব।’
দেশের অর্থনীতি আরও মজবুত, উন্নত ও চাঙা হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ নিজের পায়ে ভর করে চলবে, কারও মুখাপেক্ষী থাকবে না।
এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘তাদের উচিত বিএনপির দিকে নজর দেয়া। কারণ, কানাডার হাইকোর্ট বিএনপিকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। সন্ত্রাসী এবং দুর্নীতির দায়ে এই আমেরিকাই কিন্তু তারেক রহমানকে ভিসা দেয়নি।’
সূত্র – সময় অনলাইন।