ভাষা আন্দোলনে জামালপুর

প্রকাশিত: ১২:২১ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০২৫

জামাল্পুর প্রতিনিধি:

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা হিসেবে আদায় করা হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালির আত্মশক্তির আবিষ্কার তথা জাতিসত্তার অভূতপূর্ব জাগরণ ও বিকাশ ঘটেছিল ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির আন্দোলন-সংগ্রামের আলোকবর্তিকা হিসেবে কাজ করেছে। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিকশিত ও নবশক্তি লাভ করা বাঙালি জাতি আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে।

ভাষা আন্দোলন শুধু মুখের ভাষা কেড়ে নেবার প্রতিবাদের আন্দোলনই ছিল না, এটি অন্যায়, অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে গণ-বিস্ফোরণ ছিল। এ বিস্ফোরণের আগুন শুধু ঢাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, প্রচণ্ড বেগে ছড়িয়ে পড়েছিল সারা বাংলাদেশে। জামালপুর বরাবরই রাজনীতি ও শিল্প-সাহিত্যের সমৃদ্ধ জনপদ। তাই স্বাভাবিকভাবেই ভাষা আন্দোলনেও জামালপুরে ঘটেছিল প্রতিবাদ ও সংগ্রাম।

১৯৪৮ সালের এপ্রিল/মে থেকে জামালপুরে তৎকালীন প্রগতিশীল ছাত্র নেতা-কর্মী, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকর্মীদের তৎপরতার ফলে ভাষার চেতনা সূচনা হয়। সে সময় ভাষা বিষয়ক বিভিন্ন কমিশন গঠন ও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে সরকারের প্রচেষ্টার বিষয়ে সচেতন ছিলেন জামালপুরের রাজনীতিবিদ, ছাত্র ও সংস্কৃতিকর্মীরা।

ভাষা আন্দোলনের প্রথম থেকেই জামালপুরে সাহিত্যকর্মীদের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। ভাষাসৈনিক সৈয়দ ইমামুর রশীদের ভাষায় ৫০-এর দশক ছিল প্রতিবাদী দশক। ভাষা আন্দোলনের পূর্বে সাহিত্যে দুটি ধারা ছিল। একটি প্রগতিশীল, অন্যটি প্রতিক্রিয়াশীল তথা পাকিস্তানি ধারা। প্রগতিশীল সাহিত্যকর্মীদের নিয়ে ১৯৫১ সালে ‘প্রবাহ সাহিত্য মজলিশ’ নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে। এর সাথে যুক্ত ছিলেন সৈয়দ ইমামুর রশীদ, সৈয়দ আব্দুস সাত্তার, ক্ষিতীশ তালুকদার, অরুণ তালুকদার, আবদুর রহমান সিদ্দিক, সৈয়দ আব্দুস সোবহান, অধ্যাপক জহুরুল ইসলাম, সরকারি স্কুলের রেবতী প্রমুখ। সেই সময় হকার শান্তিবাবুর মাধ্যমে সত্যযুগ, সীমান্ত পত্রিকা জামালপুরে আসতো। প্রবাহের কর্মীরা ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্য চেতনার বাইরে স্বদেশমুখী একটি প্রগতিশীল ধারা সৃষ্টির চিন্তা করেন। সপ্তাহে একদিন প্রবাহের মজলিশ বসতো সিংহজানী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে (বর্তমানে গার্লস স্কুল)। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন প্রবাহের সাহিত্যকর্মীদের প্রতি কড়া নজর রাখতো। সাহিত্য সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রবাহ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকাও বের করা হতো। পরবর্তীকালে প্রবাহ সাহিত্য মজলিশের সবাই সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন এবং নেতৃত্ব দেন।

১৯৫১ সালের শুরুতেই জামালপুরে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। তৈয়ব আলী আহাম্মদকে সভাপতি, আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক জহুরুল ইসলামকে সম্পাদক এবং আখতারুজ্জামান মতি মিয়া ও আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আব্দুস সোবহানকে যুগ্ম সম্পাদক করে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। একই সাথে আখতারুজ্জামান মতি মিয়াকে আহ্বায়ক করে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলনে যারা সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন ও নেতৃত্ব দিয়েছেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন – আখতারুজ্জামান মতি মিয়া, সৈয়দ আব্দুস সোবহান, দিদারুল আলম খুররম, ফজলুল করিম মিঠু, আলী আসাদ কালা খোকা, ফজলুল হক সাদা খোকা (ওস্তাদ), জর্জিস আহমদ খান, ডা. সোহরাব হোসেন, সৈয়দ ইমামুর রশীদ, হায়দার আলী মল্লিক, তাসির উদ্দিন আহম্মেদ মোক্তার, গিয়াস উদ্দিন, বাদশাহ আনসারী, নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ, আব্দুর রহমান সিদ্দিক, মফিউদ্দৌলা, মহিউদ্দিন আহমদ ও সরিষাবাড়ির হাতেম আলী খান।ভাষা আন্দোলনে শহরের যেসব সচেতন শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী সহযোগিতা করেছেন, তারা হলেন: অধ্যক্ষ এ.এইচ.এম.এ.কুদ্দুস, অধ্যাপক শশাংক শেখর ভট্টাচার্য, ডা. মুনির উদ্দিন আহমেদ, কফিল উদ্দিন মোক্তার, সামসুজ্জোহা মোক্তার ও অধ্যাপক নুরুল হক। এছাড়া যে সব ছাত্র ও রাজনৈতিক কর্মী অংশ নিয়েছেন, তারা হলেন: ছাত্রনেতা ফজলুল রহমান, সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্র মহিউদ্দিন মুখলেস, বালিকা বিদ্যালয়ের মতিয়া চৌধুরী (বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রী), রওশানারা, দেলওয়ারা, জান্নাতারা ও আরো অনেকে। সিংহজানী স্কুলের কাদের কুদ্দুস ও রহমান, আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র আব্দুল আউয়াল, আব্দুর রহমান, রেজাউল করিম, আনোয়ার, বখতিয়ার হোসেন, দেওয়ান পাড়ার মজিবর রহমান, আনিসুজ্জামান, সাহেদ আলী মিয়া, যমুনা স্টেশন রোডের কুদ্দুস মল্লিক, কালু মিয়া, গেদা মিয়া, জবেদ, ছনকান্দার কালু, শাহ্পুরের সামাদ মন্ডল, ময়েন উদ্দিন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তখন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীদের অলিখিত অফিস ছিল এ্যাডভোকেট মৌলভী তৈয়ব আলী আহামদের বকুলতলার চেম্বার (যন্ত্রলেখা প্রেসের পাশে)। এছাড়া রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা নিয়মিত বসতেন তমালতলার কমিউনিস্ট নেতা রমণী মোহন বাবুর অক্ষয় ফার্মেসী ও তৎকালীন রতন দেবী হলে (পরে বিশ্বনাথ টকিজ, এন্তেজার হল) এবং পাশে হিন্দি লাইব্রেরীতে (বর্তমান মার্চেন্ট একাডেমী)।

২১ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। আহুত ধর্মঘট সফল করার লক্ষ্যে নেতারা সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন নকলা, ঝিনাইগতি সফরে। বিভিন্ন স্কুল ও কলেজের ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করেন ধর্মঘট সফল ও আন্দোলনে অংশ নেওয়ার জন্য। ছাত্রদের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। ২০ ফেব্রুয়ারি দিনব্যাপী মহকুমা সদর জামালপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মিছিল বের হয়। ইতিমধ্যে পুলিশ ছাত্রনেতা আখতারুজ্জামান মতি মিয়া, দিদারুল আলম খুররম, সৈয়দ আব্দুস সোবহান, আলী আসাদ কালা খোকা, ফজলুল হক সাদা খোকা (ওস্তাদ) সহ নেতৃত্বদানকারী ৮/১০ জনের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে। হুলিয়া মাথায় নিয়েও নেতারা ছাত্রদের সংগঠিত করতে থাকেন।

২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট আংশিক সফল হয় জামালপুর, সরিষাবাড়ি, ইসলামপুর, মেলান্দহ, শেরপুর, নকলা ও নালিতাবাড়ি থানায়। জামালপুরসহ উল্লেখিত থানাগুলোর প্রতিটি স্কুল-কলেজে পালিত হয় পূর্ণ ধর্মঘট। ছাত্ররা বেরিয়ে আসে রাস্তায়, প্রতিটি থানা সদরে ছাত্রদের মিছিলে শ্লোগান ওঠে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে জামালপুর মহকুমায় ছাত্রনেতারা খবর পান যে, মেলান্দহ ছাত্রদের মিছিলে পুলিশ হামলা চালিয়েছে। খবর পেয়ে সৈয়দ আব্দুস সোবহানসহ কয়েকজন নেতা মেলান্দহ যান। ছাত্র মিছিলে পুলিশের হামলার প্রতিবাদে প্রতিবাদ সভা ও মিছিল হয়। এখানে নেতৃত্ব দেন আবদুল হাই বাচ্চুর ভগ্নিপতি ডা. মহসিন। সরিষাবাড়িতে সাধারণ ধর্মঘট ও ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। আর. ডি. এম. পাইলট হাইস্কুলের ছাত্ররা ভাষার দাবিতে মিছিল করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের সময় জামালপুর শহরের দোকানপাট, গাড়ি আংশিক বন্ধ থাকে। ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে শহরে মিছিল বের হয়। মিছিলে জামালপুর বালিকা বিদ্যালয়ের ছাত্রীরাও যোগ দেন। সন্ধ্যায় ঢাকায় গুলির সংবাদ পেয়ে তুমুল উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। এ সময় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সার্বক্ষণিক অফিস হয়ে ওঠে তৎকালীন রতন দেবী হলের পাশে হিন্দি লাইব্রেরি (বর্তমানে মার্চেন্ট একাডেমী)। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে বেশ ক’জন ছাত্র আসেন জামালপুরে। জামালপুর ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা-কর্মীরা তাদের কাছ থেকে ঢাকার পরিস্থিতি জানতে পারেন। গভীর রাত পর্যন্ত উত্তেজিত ছাত্র-জনতা সংগ্রাম পরিষদের অফিসে জমায়েত হন। ২২ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে জন্ম নেয় নতুন শ্লোগান ‘রক্তের বদলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ এবং ‘নূরুল আমিনের কল্লা চাই’। দোকানপাট, অফিস, স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। পুরো শহর হয়ে ওঠে মিছিলের শহর। নান্দিনা, দিকপাইতসহ বিভিন্ন গ্রাম থেকে দলে দলে ছাত্র-জনতা কালো ব্যাজ ধারণ করে শহরে আসতে থাকে। ঢাকায় ছাত্রদের উপর গুলির প্রতিবাদে শহরে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়।

ডাকঘর ছাড়া শহরের সমস্ত অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। সকাল ১১ টায় বকুলতলা থেকে মিছিল নিয়ে সরকারি বিদ্যালয়ের (বর্তমান জেলা স্কুল) যাওয়ার পথে পুলিশ ফাঁড়ির কাছে পুলিশ অফিসার খুরশিদ জাহান (মুর্শিদাবাদ বাড়ি) ছাত্রনেতা দিদারুল আলম খুররমকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতার অবস্থায় দিদারুল আলম খুররম ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। এরপর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্ররাও রাস্তায় বেরিয়ে আসে, মিছিলে যোগ দেয়। ২২ ফেব্রুয়ারি সারা শহর ভাষার দাবিতে ছাত্র জনতার ঢল নামে। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে জামালপুর। মোড়ে মোড়ে পথসভা অনুষ্ঠিত হয়। মাইক না থাকায় নেতারা টিনের চোঙা দিয়ে বক্তৃতা করতেন। ঐ দিন বিকেলে হিন্দু বোডিং মাঠে (বর্তমান হাইস্কুল মাঠে) ঢাকার গুলির প্রতিবাদে ছাত্র-জনতার বিশাল সমাবেশ হয়। এখানে বক্তব্য রাখেন তৈয়ব আলী আহমেদ, তাছির উদ্দিন মোক্তার প্রমুখ। এরপর এখান থেকে মিছিল সহ ছাত্র-জনতা রেল স্টেশন ময়দানে বিশাল জনসভায় যোগ দেয়। রেল স্টেশন ময়দানে প্রায় ২০ হাজার ছাত্র জনতার বিশাল সমাবেশে ঢাকায় গুলি, ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ করা হয়, নিহত পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, মুসলিম লীগ মন্ত্রীসভা ও এমএলএ-দের পদত্যাগ, ছাত্র বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি করা হয়। সভায় অবিলম্বে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানানো হয়। সভায় ১৪৪ ধারা প্রত্যাহারেরও দাবি জানানো হয়।

২২ ফেব্রুয়ারি শুধু জামালপুর শহরে নয়, সরিষাবাড়ি, মেলান্দহ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ থানায়ও ব্যাপক মিছিল-সমাবেশ হয়। জামালপুর শহরসহ সবকটি থানায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সফল হয় ২২ ফেব্রুয়ারি সর্বাত্মক ধর্মঘট। সেদিন রাতেই পুলিশ গ্রেফতার করে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা আক্তারুজ্জামান মতি মিয়া, আলী আসাদ কালা খোকা, ফজলুল হক সাদা খোকা সহ ৮ জন নেতাকে। গ্রেফতারকৃত ছাত্রনেতাদের সাতদিন জামালপুর সাবজেলে রাখার পর ১ মাসের আটকাদেশ দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ময়মনসিংহ জেলে। ময়মনসিংহ জেলে ছাত্র নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ হয় ময়মনসিংহের নেতা রফিক উদ্দিন ভুঁইয়া, আনন্দমোহন কলেজের প্রিন্সিপাল সৈয়দ বদরুদ্দিন হোসাইন, শামসুল হক, শেরপুরের কমিউনিস্ট নেতা রবি নিয়োগী, জামালপুরের কমিউনিস্ট নেতা মন্মথ দে, হেমন্ত ভট্টাচার্য, যশোরের আব্দুল হাই, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের আসামী কালী চক্রবর্তী ও রাজনীতিবিদ হাশেম উদ্দিনের সাথে। জেলে ভাষা সৈনিকদের নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন প্রাক্তন মন্ত্রী সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ। কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ৫ মার্চ দেশব্যাপী ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই ধর্মঘট সফল এবং আন্দোলনকে বেগবান করার লক্ষ্যে ২৫ ফেব্রুয়ারি জামালপুরে আহ্বান করা হয় ছাত্র জনতা জমায়েত। নেতারা বেরিয়ে পড়েন থানা সফরে। থানাগুলোতে ব্যাপক জনসংযোগ, সভা ও শোভাযাত্রা হয়। প্রতিটি শোভাযাত্রায় নেতা-কর্মীরা কালো ব্যাজ ধারণ করতেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দুয়া কালিবাড়িতে ভাষার দাবিতে বিরাট জনসভা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সরিষাবাড়ি পিংনা হাইস্কুল মাঠে হাতেম আলী খানের সভাপতিত্বে কয়েক হাজার ছাত্র জনতার এক বিরাট সমাবেশ হয়। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ছাত্রনেতা সৈয়দ আবদুস সোবহান, সুজায়াত আলী প্রমুখ। সমাবেশে ভাষা শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা, শোকসন্তপ্ত শহীদ পরিবারের প্রতি সমবেদনা, সরকারি কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জানানো হয়। সভায় নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ঐদিন সরিষাবাড়ি আরডিএম হাইস্কুল প্রাঙ্গনেও এক বিরাট সভা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি মেলান্দহ, ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জসহ বিভিন্ন থানায় ছাত্র জনসভা ও শোভাযাত্রা বের হয়। ২১ থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চার দিনব্যাপী হরতাল পালিত হয় সরিষাবাড়িতে। অন্যান্য থানাতেও ধর্মঘট পালিত হয়।

২৫ ফেব্রুয়ারিতে জামালপুর শহরে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। সেদিন জামালপুর শহর মিছিলের শহরে পরিণত হয়। দিনব্যাপী শহরে খণ্ড খণ্ড মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। শ্লোগান চলতে থাকে ‘রক্তের বদলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘নুরুল আমিনের কল্লা চাই’। ২৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্রীরা রাস্তায় বেরিয়ে আসেন এবং পিকেটিংয়ে অংশ নেন। বিক্ষুব্ধ জনতা সেদিন ডেপুটি সিভিল সার্জন অফিস, সমাজকল্যাণ দফতর ও মহকুমা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও করে রাখে। মহকুমা প্রশাসক এম. এ. হাসান জনতার প্রতিরোধে অফিসে যেতে পারেননি। কোনো অফিসার বা কর্মচারীই সেদিন অফিসে যাননি। ছাত্ররা তৎকালীন এম.এল.এ আলী আহমদ কালা মৌলবীকে ধাওয়া করলে পুলিশ সেদিন ছাত্রদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। ২৫ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট জামালপুরসহ সকল থানায় সর্বাত্মকভাবে সফল হয়। ঐদিন বিকেলে হিন্দি লাইব্রেরীতে আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যাপক জহুরুল ইসলামের সভাপতিত্বে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করার দাবি জানিয়ে বাংলায় উর্দু হরফ চালানোর পরিকল্পনার নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি জামালপুর শহর থেকে ৭ মাইল দূরে অবস্থিত নান্দিনায় সিরাজুল হকের সভাপতিত্বে প্রায় তিন হাজার লোকের এক জনসভায় ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ করে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান, বন্দীদের মুক্তি ও মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি জামালপুর কলেজ টিচার্স কাউন্সিলের এক সভা হয়। আশেক মাহমুদ কলেজের অধ্যক্ষ এ. এইচ. এম কুদ্দুসের (নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের বাবা) সভাপতিত্বে সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করার জন্য দাবি জানানো হয়। অন্যান্য প্রস্তাবে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ এবং গুলিবর্ষণের নিরপেক্ষ বিচার দাবি করে সরকার, ছাত্র ও জনসাধারণের কাছে আবেদন করা হয় যে, তারা যেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কাজকর্ম পরিচালনার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টিতে সহায়তা করে। ১ মার্চ দেওয়ানগঞ্জ হাইস্কুল মাঠে নাদের হোসেনের সভাপতিত্বে এক জনসভা হয়। সভায় ঢাকায় ছাত্র মিছিলে গুলিবর্ষণের প্রতিবাদ জানানো হয় এবং বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের দাবীসহ গণপরিষদে পূর্ববঙ্গের সদস্যদের পদত্যাগ, পূর্ববঙ্গের মন্ত্রীসভার পদত্যাগ, গুলিবর্ষণ সম্পর্কে স্থানীয় এমএলএ’র নিরবতার কৈফিয়ত দাবি এবং নিহতদের রুহের মাগফেরাত কামনা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

৩ মার্চ পর্যন্ত জামালপুর শহর ও থানাগুলোতে ভাষার দাবীতে প্রতিদিন সভা, সমাবেশ ও মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ৩ মার্চ কৃষক দিবসে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জামালপুরসহ সব কটি থানায় পূর্ণদিবস ধর্মঘট পালিত হয়। এছাড়াও ৫ মার্চ সিংহজানী মাঠে তৈয়ব আলীর সভাপতিত্বে ভাষার দাবীতে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ মহকুমা ছাত্রলীগ ও কলেজ ছাত্র সংসদের উদ্যোগে স্কুল কলেজে ধর্মঘট ও বিশাল মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। ১২ মার্চ গোপার দত্তের মাঠে ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।

জামালপুরে প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপিত হয় ১৯৬৩ সালে। আশেক মাহমুদ কলেজের বড় পুকুরের উত্তর-পূর্ব কোণে কয়েকটি ইট দিয়ে শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ১৯৬৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ছাত্র নেতারা সিংহজানী হাই স্কুল, সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, সরকারি গার্লস স্কুলের অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে সংগঠিত করে খালি পায়ে প্রভাতফেরি করেন এবং সদ্য নির্মিত বেদীতে ফুল দেন। ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত এই শহীদ মিনারেই প্রভাতফেরি শেষে ফুল দিয়ে স্মরণসভা করে শহীদ দিবস পালন করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে শহরের মাঝখানে দয়াময়ীতে (পুনাইপার্ক) তিনটি স্তম্ভ দিয়ে শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা কলেজ পুকুর পাড়ের শহীদ মিনারের পিলার এবং দয়াময়ীর মোড়ের (পুনাইপার্ক) শহীদ মিনারটি ভেঙে দেয়। ১৯৭২ সালে পুনরায় দয়াময়ী মোড়ের (পুনাইপার্ক) শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপিত হয়। ১৯৭৭ সালে এ শহীদ মিনারটি পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনারের রূপ পায়।

জামালপুরের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক প্রদীপ কান্তি মজুমদার মহান একুশের উপর একটি গান লিখেন। গানটি নিম্নরূপ –

জাগো জাগো জাগোরে বাঙালি
একুশের আহ্বানে
রাজপথ হলো রক্তে রাঙানো
যাদের জীবন দানে
মহনা একুশের আহ্বানে।।
বাঙলা ভাষা, যে মাতৃভাষা
পেয়েছিল অবহেলা
বীর ছাত্ররা তারি লাগি হায়
জীবন দিয়েছে হেলায়।
সেদিনের স্মৃতি প্রেরণা জাগায়
আজিকে সবার প্রাণেৎ
মহান একুশের আহ্বানে।
জাগো জাগো জাগোরে বাঙালি
একুশের আহ্বানে

মহান ভাষা আন্দোলন এবং জামালপুরের প্রেক্ষাপট আলোচনায় দেখা যায় খাটি দেশপ্রেম, গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে ভাষাসংগ্রামীরা আন্দোলন করেছেন। মাতৃভাষা রক্ষার জন্য তারা নির্যাতন, নিপীড়ন ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন। তাদের আত্মত্যাগ বাঙালি জাতির একটি উজ্জ্বল ঘটনা। দেশ ও সমাজের জন্য ভাষাসংগ্রামীরা যে আত্মত্যাগ করেছেন, জামালপুরবাসীসহ সকল দেশবাসী শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করবে। ইতিহাসের পাতায় তাদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

তথ্যসূত্র:
১। ভাষা আন্দোলনের আঞ্চলিক ইতিহাস : আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন : (জামালপুর : শফিক জামান) বাংলা একাডেমী
২। আমি কি ভুলিতে পারি? সৈয়দ আব্দুস সোবহান : ভাষাসৈনিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী
৩। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র : দ্বিতীয় খন্ড : সম্পাদনা হাসান হাফিজুর রহমান
৪। অমর : সম্পাদনা সৈয়দ আব্দুস সাত্তার ও দিদারুল আলম খুররম
৫। ভাষা আন্দোলনে জামালপুর : মেহেদী ইকবাল : সংবাদ : ৮ ফাল্গুন ১৩৯৮
৬। ধ্রুবতারা : প্রথম খন্ড : ভাষাসৈনিক মতি মিয়া ফাউন্ডেশন : ২১ ফেব্রুয়ারি : ১৯১৪