এবার গোয়েন্দা পুলিশের জালে দুদক কর্মচারীসহ গ্রেফতার ৪

প্রকাশিত: ৬:২০ অপরাহ্ণ, জুন ২৪, ২০২৩

মো. সাইফুল ইসলাম :

সমাজে ঘুষ-দূর্নীতি অনিয়মকারীদের আতংকের নাম দুদক। যাদের দায়িত্ব সমাজ থেকে এসব অপরাধী নির্মূল করা। যারা রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে কঠোর ভুমিকা পালন করে জনগণের আস্থা কুড়িয়ে বীরদর্পে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে চলছিল, সেই দুদকের এক কর্মচারীসহ ৪ জন এক ব্যবসায়ীকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করতে গিয়ে এবার গোয়েন্দা পুলিশের হাতে ধরা পরেছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে নগদ টাকা, মোবাইল ও বিভিন্ন কাগজপত্র উদ্ধার করা হয়। এরা হলেন- গৌতম ভট্টাচার্য (৪২), হাবিবুর রহমান (৪২), পরিতোষ মন্ডল (৬৩) ও মো. এসকেন আলী খান (৫৭)। আজ শনিবার (২৪ জুন) দুপুরে নিউজ পোস্ট বিডিকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) কে এন রায় নিয়তি।

তিনি বলেন, গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) লালবাগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) রাকিবের নেতৃত্বে গতকাল শুক্রবার (২৩ জুন) দুপুরে রাজধানীর মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেলে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো–গৌতম ভট্টাচার্য (৪২), হাবিবুর রহমান (৪২), পরিতোষ মন্ডল (৬৩) ও মো. এসকেন আলী খান (৫৭)। গ্রেফতারের সময় তাদের হেফাজত থেকে মিষ্টির চারটি প্যাকেট, নগদ দেড় লাখ টাকা, চারটি মোবাইল ফোন, দুদকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের একটি খাম ও দুদকের একটি নোটিশ উদ্ধার করা হয়েছে।

গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে গৌতম ভট্টাচার্য দুদকের মানিলন্ডাডরিং বিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) মো. মোকাম্মেল হকের পিএ হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তার বাড়ি মৌলভীবাজারে। এসকেন আলী খান চাকরিচ্যুত পুলিশ সদস্য। তার বাড়ি গোপালগঞ্জে। অপর দুই জন গোপালগঞ্জের বাসিন্দা এবং পেশাগতভাবে দালাল ও প্রতারক চক্রের সদস্য।
ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার কে এন রায় নিয়তি বলেন, গ্রেফতারকৃতরা আশিকুজ্জামান নামে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীর কাছে এক কোটি টাকা দাবি করে। আশিকুজ্জামান বায়তুল মোকাররম মসজিদ মার্কেটে কার্পেটের দোকানে ইমপোর্ট করা কার্পেট ও জায়নামাজ সরবরাহ করে থাকেন। গত ১৯ জুন তার স্ত্রী সন্তান প্রসব করা সংক্রান্তে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। পরদিন ২০ জুন সকালে আশিকুজ্জামানের উত্তরার বাসায় দুদুকের মনোগ্রাম সম্বলিত খাকি রঙের খামে একটি নোটিশ নিয়ে হাজির হন এক ব্যক্তি। কার্পেটের ব্যবসার আড়ালে স্বর্ণের চোরাচালান এবং মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত বিভিন্ন অভিযোগ তোলা হয় আশিকুজ্জামানের বিরুদ্ধে। স্ত্রীর হাসপাতালে অবস্থান এবং দুদকের এই ভয়ানক অভিযোগ শুনে ঘাবড়ে যান আশিকুজ্জামান। দুদকের কথিত সেই অফিসার আশিকুজ্জামানকে একটু সহানুভূতি দেখানোর ভান করে তাকে তখনই মোবাইল বন্ধ করে আত্মগোপনে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। ভয় দেখানো হয়, ডিবি, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক এবং এনএসআই দুর্নীতি সংক্রান্ত বিষয়ে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। দুদকে তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুর্নীতি সংক্রান্ত একটি অভিযোগ আমলে নেওয়া হয়েছে।

নোটিশ বহনকারী ব্যক্তি হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের একজন কথিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে আশিকুজ্জামানকে কথা বলিয়ে দেয়। হোয়াটসঅ্যাপে দুদকের ওই কর্মকর্তা মোবাইলে কথা বলা সমীচীন নয় বলে বিস্তারিত জানার জন্য তাকে দুদক অফিসে সশরীরে হাজির হতে বলে। দুদকের নোটিশে বিভিন্ন অভিযোগের পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়, ‘শূন্য থেকে তিনি আজ কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। তাকে দুদকের জিম্মায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সকল প্রমাণ পাওয়া যাবে। এমতাবস্থায় প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন’। কারণ দর্শানোসহ ব্যক্তিগত শুনানির জন্য আগামি ১০ জুলাই (২০২৩) তারিখ নির্ধারণ করা হয়।

ঘাবড়ে যাওয়া আশিকুজ্জামানকে দফায় দফায় ফোন দেওয়া হয় হোয়াটসঅ্যাপে। ভয় দেখানো হয় সম্পত্তি ক্রোক, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে বেইজ্জতি করাসহ সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনএসআই, ডিবি পুলিশ এবং দুদক দিয়ে গ্রেফতার করিয়ে কঠোর শাস্তির। এক পর্যায়ে আশিকুজ্জামানকে মতিঝিলের হিরাঝিল হোটেলের দ্বিতীয় তলায় এসে সমঝোতার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। সমঝোতা অনুসারে প্রথমে দুই কোটি টাকা দিতে বলা হলেও পরবর্তীতে দিতে বলা হয় এক কোটি টাকা। বিনিময়ে সকল অভিযোগ থেকে অব্যাহতির নিশ্চয়তা দেওয়া হয়। এক কোটি টাকার মধ্যে ২৩ জুন শুক্রবার জুমার নামাজের আগে ২০ লাখ টাকা দিতে বলা হয়। বাকি টাকা আগামী রবিবার ব্যাংক আওয়ারে পরিশোধের সমঝোতা হয় প্রতারকদের সঙ্গে।

বিষয়টি ব্যবসায়ী আশিকুজ্জামান লালবাগ বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশকে অবহিত করেন। অভিযোগ পেয়ে ডিএমপির লালবাগ বিভাগ দুদকের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং দুদকের উপ-পরিচালক নজরুল ইসলামসহ হোটেল হিরাঝিলের আশেপাশে অবস্থান নেয়। সমঝোতা অনুসারে ভিকটিম আশিকুজ্জামান চারটি মিষ্টির প্যাকেটে (তার সই করা) দেড় লাখ টাকা ভরে হোটেল হিরাঝিলে যান। তার কাছ থেকে মিষ্টির প্যাকেটে সংরক্ষিত টাকা গ্রহণ করার সময় আশেপাশে অবস্থান নেওয়া গোয়েন্দা পুলিশ চার জনের ওই চক্রকে হাতেনাতে গ্রেফতার করে।

পুলিশ জানায়, গ্রেফতারকৃত গৌতম ভট্টাচার্য দীর্ঘদিন ধরে দুদকের একাধিক মহাপরিচালকের পিএ হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। কখনও দুদকের ডিজি (তদন্ত), ডিজি (অ্যাডমিন), ডিজি (প্রসিকিউশন), ডিজি (মানিলন্ডারিং) এর অফিসের পার্সোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট (পিএ) হিসেবে কাজ করে আসছেন। গৌতম ভট্টাচার্য কর্মসূত্রেই জানেন, দুর্নীতি সংক্রান্তে কীভাবে মানুষকে নোটিশ পাঠাতে হয়। কীভাবে তাদের কাছ থেকে আত্মপক্ষ সমর্থনমূলক ব্যাখ্যা নেওয়া হয় এবং অভিযোগ গঠন করা হয়। এই অভিজ্ঞতা এবং জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে সে তার দুষ্কর্মের সহযোগীদেরকে দিয়ে বিভিন্ন ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং চাকরিজীবীকে টার্গেট করে তাদের ব্যক্তিগত নানা তথ্য সংগ্রহ করে দুদকের চিঠির খাম, প্যাড ও ফরমেট ব্যবহার করে অভিযোগের নোটিশ পাঠাতো। পরবর্তী সময়ে কখনও মোবাইলের হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলে, কখনও শিল্পকলা একাডেমীর ভেতরে বসে, কখনও আশেপাশের বিভিন্ন হোটেলে টার্গেটকারীর টাকায় খেতে খেতে তাদেরকে অভিযোগের দায় থেকে অব্যাহতি দান ও সমঝোতার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। তার সঙ্গে দুদক কার্যালয়ের দায়িত্বশীল আরও কেউ জড়িত আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য আসামিদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান গোয়েন্দা পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপ কমিশনার মশিউর রহমান।

গোয়েন্দা পুলিশের এই কর্মকর্তা আরও জানান, এই চক্রের সঙ্গে আরও কেউ জড়িত রয়েছে কি-না তা জানার জন্য রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আজ শনিবার দুপুরের দিকেই তাদের ৪ জনকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।