
ক্রীড়া ডেস্ক:
‘যেতে নাহি দিব হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।’ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই কবিতার সাথে জীবনের মিল পাওয়া যায় হরহামেশাই। সময় আর পরিস্থিতি বলে দেয়, কে কখন কোথায় অবস্থান করবে। গতকাল বুধবার পুরো দিনই বলতে গেলে আলোচনায় ছিলেন মুশফিকুর রহিম। দুপুর নাগাদ স্টিভেন স্মিথের অবসর ঘোষণার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দর্শকরা বেশ জোরালোভাবে মুশফিককে ইঙ্গিত করে পোস্ট দিতে থাকেন, সঙ্গে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে নিয়েও।
দিনভর চলতে থাকা এসব পোস্ট শেষ না হতেই রাত ১১টা ১৩ মিনিটে ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসরের ঘোষণা দেন মুশফিকুর রহিম। নিজের ফেসবুক পেজে দীর্ঘ এক স্ট্যাটাসে প্রায় দুই দশকের ক্যারিয়ারের ইতি টানেন দেশের ক্রিকেটের কিংবদন্তি এই ক্রিকেটার। সাম্প্রতিক সময়টা ব্যাট হাতে ভালো যাচ্ছিল না মুশফিকের। যে কারণে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি শেষ না হতেই দিলেন অবসরের ঘোষণা।
টি-টোয়েন্টি থেকে ২০২২ সালে অবসর নিয়েছিলেন মুশফিক। গতকাল ওয়ানডে ক্রিকেট থেকে অবসর নিলেও চালিয়ে যাবেন টেস্ট ক্রিকেট। মুশফিকের অবসর খবরের পরপরই ঢাকা পোস্টকে নিজের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন মুশফিকের বিকেএসপির কোচ মন্টু দত্ত। দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে কাছ থেকেই মুশফিককে দেখে আসছেন মন্টু। এই কোচ জানাচ্ছিলেন, ‘আমি ২০০০ সালে মুশফিককে প্রথম পেয়েছিলাম রাজশাহীতে। পরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম একটা প্রথম শ্রেণীর খেলায়। উত্তরা ক্লাবে খেলেছিলাম একসাথে। আমার মনে হয় সে সঠিক কাজটাই করেছে, অনেক জুনিয়ারের কথা অবশ্য চিন্তা করেছে সে। মুশফিকের জন্য শুভকামনা সবসময় থাকবে।’
পরে মন্টু দত্ত বলছিলেন মুশফিক সঠিক কাজটিই করেছে, ‘আমি মনে করি যে ওর ঠিক সময় ঠিক কাজটাই করেছে। একটা ক্রিকেটারের ফর্মে থাকা অবস্থায় যদি বিদায় নেয় তাহলে সেটাই ভালো। সিদ্ধান্তটা সে অনেক বুঝে শুনেই নিয়েছে। এ সিদ্ধান্তে সম্মানটা থাকবে, বাংলাদেশের জন্য সে যথেষ্ট করেছে।’
মুশফিকের ছোট বেলার কথা জানাতে গিয়ে মন্টু বলছিলেন, ‘মুশফিক অনেক পরিশ্রমী ছিল ছোট থেকেই। তার মত এত পরিশ্রমী প্লেয়ার বাংলাদেশে আসবে কিনা আমার সন্দেহ। অনুশীলনে কখনো সে ফাঁকি দেয়নি, যখন সিনিয়র হয়েছে তখনও সে তার অনুশীলনটা ঠিক মতো চালিয়ে গিয়েছে। তার মত পরিশ্রমী পাওয়া মুশকিল, এখন তো আরো কঠিন।’
বিকেএসপিতে ছোট বেলায় দেখে অবশ্য মুশফিককে নিয়ে এতটাও উচ্চাশা ছিল না মন্টু দত্তের, ‘শুরুর দিকে দেখে তো আসলে কখনোই ভাবি নি। ছোট অবস্থায় যখন তাকে দেখেছিলাম আগে আরো ছোটখাটো ছিল। খুব চুপচাপ থাকতো, লেখাপড়ায় ভালো ছিল, বুদ্ধি ভালো ছিল। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আলাদা একটা দৃষ্টি ছিল সে কিপিং যেটা করত খুব সুন্দর। সে ছোটবেলায় ১২০ বল খেলেছে রান করেছে ২৫ এমনও আছে। টেস্ট খুব ভালো খেলত।’
মুশফিকের এমন অবসর নিয়ে সদ্য পদত্যাগ করা বিসিবির নির্বাচক হান্নান সরকারও জানিয়েছেন প্রতিক্রিয়া। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলছিলেন, ‘বাংলাদেশকে কিন্তু একটা স্টেজ থেকে আর একটা স্টেজে নিয়ে যাওয়ার পেছনে মুশফিকের অনেক অবদান রয়েছে। এটা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। তো সেখান থেকে আমার মনে হয় যে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেছে সে। এটাকে অবশ্যই সম্মান জানাতে হবে, আর যার যে অবস্থা তারটা সে নিজেই ভালো বুঝে।’
হঠাৎ মুশফিকের এমন সিদ্ধান্ত কী কারণ হান্নান বলছিলেন, ‘আমার মনে হয় টেস্ট ক্রিকেটে আরো বড় সময় দেয়ার ক্ষেত্রে যদি এরকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই সেটা ভালো হবে।’ তবে টি-টোয়েন্টির পর ওয়ানডেতেও মুশফিকের বিদায় মাঠ থেকে এবারো হলো না। হান্নান সরকারের আক্ষেপও সেখানেই, ‘হতে পারলে তো অবশ্যই ভালো হতো। আমি তো আসলে এ ব্যাপারে কিছু জানি না এ বিষয়ে কোন কথা হয়নি। যখন যুক্ত ছিলাম আগে তখন সে বিষয়ে কথা হয়েছে। এ বিষয়ে সিলেক্টর বা বোর্ডের সাথে কথা হয়েছে কি না আমি জানিনা, তবে নিশ্চয় হয়েছে।’
‘ওর নামের সাথে যেটা মিস্টার ডিপেন্ডেবল সেটাও মনে থাকবে অনেক দিন। আমার মনে হয় মাঠ থেকে তখন বিদায় নেবে সে, যখন সব ফরম্যাট থেকে ছেড়ে দিবে খেলাটা। মুশফিককে এখনো টেস্টে দরকার।’
মুশফিকের সঙ্গে স্মৃতি রোমান্থন করে হান্নান বললেন, ‘সিলেক্টর হিসেবে ওর সাথে আমার খুব বেশি অ্যাটাচমেন্ট ছিল এটা বলবো না। তবে এর আগে একসাথে বিপিএল কাজ করেছিলাম ২০১২ সালে দুরন্ত রাজশাহীতে। আমি সহকারী কোচ ছিলাম রাজশাহীর। একটা বিষয় শেয়ার করতে পারি মুশফিকের প্রথম প্রিমিয়ার লিগ ২০০৪ সালে আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম।’
‘তখন আমি ন্যাশনাল টিমে ছিলাম ও প্রথম প্রিমিয়ার লিগে ছিল। সে অনেক ছোট ছিল তখন আমরা একই দলে ছিলাম। মুশফিকের মাত্র শুরু এর পরে কোচ হিসেবে পেয়েছি, সিলেক্টার হিসেবে পেয়েছি। তার সাথে তিন বিভাগে কাজ করাটা আমার জন্য অবশ্যই একটা বড় পাওয়া।’
সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার সময়ে তার প্রথম অধিনায়ক হাবিবুল বাশার সুমনও। জানালেন ২০ বছর আগের সেই গল্প, ‘২০০৫ সালে সে প্রথম এসেছিল তখন আমরা একটা প্লান করছিলাম। যে দলে একজন জেনুইন ব্যাটসম্যান সঙ্গে উইকেটকিপার সে। মুশফিক দলে আসায় আমাদের দলে অনেক বড় একটা পরিবর্তন এসেছিল। একজন প্রোপার ব্যাটসম্যান ছিল উইটেককিপারসহ। পরে যখন ইংল্যান্ডে গেল খুব বেশি রান করতে পারছিল না, তখন ওর টেকনিক নিয়ে সবাই কথা বলছিল।’
মুশফিকের অবসর নিয়ে কথা বলতে গিয়েও চলে আসলেন সাকিব আল হাসান। বাশার বলছিলেন, ‘সেখানে অনুশীলন ম্যাচে একটা সেঞ্চুরি করেছিল। তখন আবারো টেকনিকটা খুব ভালো দেখতে পাই। ছোট হলেও সে কিন্তু বড় বড় ছক্কা মারতো তখন থেকেই। ও এবং সাকিব থাকায় দলের জন্য বিশাল বড় একটা সুযোগ ছিল। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইনআপ অনেক বড় হতো, সেটা অবশ্যই মিস করবে দল।’
মুশফিককে এখনো টেস্টে দরকার দাবি করে বাশার বলেন, ‘ওর নামের সাথে যেটা মিস্টার ডিপেন্ডেবল সেটাও মনে থাকবে অনেক দিন। আমার মনে হয় মাঠ থেকে তখন বিদায় নেবে সে, যখন সব ফরম্যাট থেকে ছেড়ে দিবে খেলাটা। মুশফিককে এখনো টেস্টে দরকার।’
মাঝ রাতেই কথা হচ্ছিল যেহেতু বাশারের সঙ্গে। সবশেষে মুশফিকের সঙ্গে একটা মজার স্মৃতি মনে করে বললেন, ‘হি ইজ এ ভেরি সিরিয়াস ক্যারেক্টার। তবে শুরুতে যখন এসেছিল মুশফিক, কিপিং করত আমরা স্লিপে দাঁড়িয়ে ওকে খুব জ্বালাইতাম। ছোট্ট মানুষ ছিল নতুন এসেছে খুব লজ্জা পেতো। আমরা সিনিয়ররা ছিলাম, ওকে আমরা খুব জ্বালাতাম মনে আছে এখনো। কিন্তু হি ইজ এ সিরিয়াস ক্যারেক্টার।’