
নিজস্ব প্রতিবেদক:
সময়কাল ১৯৭৯। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নারী কূটনীতিক হিসেবে প্রথম পা রাখেন নাসিম ফেরদৌস। চাকরির দুই যুগের মাথায় পেশাদার কূটনীতিক থেকে রাষ্ট্রদূত হওয়া প্রথম নারী তিনি। তার দেখানো পথে ইতোমধ্যে নিজ মেধা-যোগ্যতায় কূটনীতিতে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান করে নিয়েছেন আরও অনেক নারী। তারা পুরুষের সঙ্গে সমানতালে দেশে-বিদেশে দূতিয়ালিতে দ্যুতি ছড়াচ্ছেন।
কয়েক বছর ধরে ৭-৮ জন রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার বহির্বিশ্বে অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে লাল-সবুজের পতাকাকে তুলে ধরছেন। বর্তমানে ৭ জন নারী রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার লন্ডন, অটোয়া, কায়রো, এথেন্স, বন্দর সেরি বেগওয়ান, বুখারেস্ট এবং ব্রাসিলিয়ায় ঢাকার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও মায়ামিতে কনস্যুলেট জেনারেল, নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে উপস্থায়ী প্রতিনিধি, স্টকহোমে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত (চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স), ব্যাংকক, দুবাই ও ব্রাসেলসে উপ-রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন তিন পেশাদার নারী কূটনীতিক।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, নাসিম ফেরদৌস বা তার সমসাময়িক উত্তরসূরিরা ‘নারী’ হিসেবে কূটনীতি পেশায় যতটা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন, সেটি এখন আর সেই অর্থে নেই বললেই চলে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকা মহাদেশের বিভিন্ন দেশে নারী কূটনীতিকরা অত্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন। সদর দপ্তর ঢাকায়ও তারা বিভিন্ন গুরত্বপূর্ণ পদে কাজ করছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, বর্তমানে ৭ নারী রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার রয়েছেন। আছেন ২ কনসাল জেনারেল, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত, উপস্থায়ী প্রতিনিধি, তিন উপ-রাষ্ট্রদূত বা মিনিস্টার পদমর্যাদার কর্মকর্তা, কাউন্সেলর এবং দূতালয়ের প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সচিব মিলে বিদেশের বাংলাদেশ মিশনে রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার ছাড়া ৩৫ জন পেশাদার নারী কূটনীতিক কর্মরত আছেন।
সদর দপ্তর ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ৩১ জন পেশাদার নারী কূটনীতিক কর্মরত আছেন। যার মধ্যে মহাপরিচালক পদে আছেন ৬ জন (বর্তমানে এক মহাপরিচালক ট্রেনিংয়ে আছেন), পরিচালক পদে ৭ জন, ডেপুটি চিপ অব প্রটোকল মিশন সার্ভিস ও পলিসি (পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা) দুই নারী কূটনীতিক কর্মরত আছেন। এছাড়া, সিনিয়র সহকারী সচিব এবং সহকারী সচিব রয়েছেন বেশ কয়েকজন।
বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের হাইকমিশনার আবিদা ইসলাম, কানাডায় হাইকমিশনার নাহিদা সোবহান, মিশরে রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ, ব্রুনাই দারুস সালামে রাষ্ট্রদূত নওরীন আহসান, গ্রিসে রাষ্ট্রদূত নাহিদা রহমান সুমনা, রোমানিয়ায় রাষ্ট্রদূত শাহনাজ গাজী এবং ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত সাদিয়া ফয়জুন্নেসা।
এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও মায়ামিতে কনসাল জেনারেল হিসেবে সামিয়া আঞ্জুম এবং সেহেলী সাবরিন দায়িত্ব পালন করছেন। নিউইয়র্কে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে উপস্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে আছেন কূটনীতিক ইসরাত আরা, থাইল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং ব্রাসেলসে মিশন উপপ্রধান হিসেবে আছেন মালেকা পারভীন, শাহনাজ আক্তার রানু এবং প্রীতি রহমান, সুইডেনে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত আমরিন জাহান।
নারী কূটনীতিক হিসেবে পেশাগত চ্যালেঞ্জ ও নারী ক্ষমতায়ন নিয়ে মিশরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সামিনা নাজ ঢাকা পোস্টকে বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ একটি কণ্ঠস্বর। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে নারীর অধিকার ইস্যুতে জাতিসংঘে আমাদের যে অবস্থান ছিল সেটা থেকে আমরা কিছুটা মনে হয় পেছনে চলে যাচ্ছি। আমাদের যে অবস্থান সেটাকে আরও এগিয়ে নিতে হবে, পিছিয়ে গেলে হবে না। আমার মনে হয়, জাতিসংঘে আমাদের আরও সোচ্চার হওয়া দরকার। কূটনৈতিক পেশায় কেন সব পেশায় কাজ করতে গেলে চ্যালেঞ্জ থাকবে। নারী-পুরুষ বড় কথা নয়। আমি কাজ করতে এসেছি কাজ করব।
পুরুষের সহযোগিতায় নারীরা কর্মক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যেতে পারে উল্লেখ করে সামিনা নাজ বলেন, পুরুষ সহযোগিতা করেছে বলে আমরা এতদূর আসতে পেরেছি। আমার বাবা থেকে শুরু করে স্বামী বা অফিস কলিগ সবার সহযোগিতার কারণে কর্মক্ষেত্রে আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। কিন্তু এই সুযোগ বাংলাদেশের সব নারী পায়, সেটাও কিন্তু বলা যাবে না। নারীরা সুযোগ পেলে হয়ত আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারবে।
গ্রিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত নাহিদা রহমান সুমনা বলেন, একটা সময় সবাই রাষ্ট্রদূত বা হাইকমিশনার হতে পারত না। পদোন্নতি এবং পদায়নের সংখ্যা বাড়ায় এখন রাষ্ট্রদূত হওয়া নারী-পুরুষ সবার জন্য অনেকটা সহজ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রদূত হিসেবে সবাইকে সমান কষ্ট করতে হয়। চ্যালেঞ্জের ক্ষেত্রে নারীদের পরিবারের বিষয়টি সামনে চলে আসে। একইসঙ্গে নতুন দেশে গেলে খুব কম কূটনীতিক আছেন কাজের তালিকা, ভাষা দক্ষতা বা অন্যান্য প্রস্তুতি নিয়ে যেতে পারেন না। বিশেষ করে, ভাষা ও সংস্কৃতি সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে দেখছি। ভাষা জানা থাকলে কাজের ক্ষেত্রে দরজা খোলা সহজ।
তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্রদূত একটা বিশাল দায়িত্ব। বিদেশের মাটিতে নিজের দেশের হয়ে নেতৃত্ব দেওয়া। আমি কি এই বিশাল দায়িত্বের যোগ্য কি না বা আমি যোগ্য হতে পরেছি কি না সেটি একটি বড় প্রশ্ন। আমি চেষ্টা করি দেশের মর্যাদা বাড়াতে।
পেশাদার কূটনীতিক না হয়েও রাজনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের প্রথম নারী হাইকমিশনার হন তাহমিনা খান ডলি। শ্রীলঙ্কাতে প্রায় দুই বছর (১৯৮০-৮১) তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্য থেকে প্রথম নারী রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন মাহমুদা হক চৌধুরী। তিনি ১৯৯৬-৯৮ পর্যন্ত ভুটানে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন। মাহমুদা হকও পেশাদার কূটনীতিক ছিলেন না।
পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিয়োগ পান আরও অন্তত ৩ জন বাংলাদেশি নারী রাষ্ট্রদূত। সেই তালিকায় রয়েছেন- নেদারল্যান্ডস প্রবাসী রাজনীতিবিদ শেলী জামান। তিনি ১৯৯৯-২০০১ স্পেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। অন্য দুইজন শিক্ষাবিদ সেলিনা মোহসিন এবং ইয়াসমিন মোর্শেদকে রাষ্ট্রদূত করা হয়।
১৯৭৯ সালে ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়া প্রথম নারী কূটনীতিক নাসিম ফেরদৌসকে ২০০২ সালে রাষ্ট্রদূত করে ইন্দোনেশিয়ায় পাঠানো হয়। পেশাদার কূটনীতিক থেকে রাষ্ট্রদূত হওয়া প্রথম নারী তিনি। তারই ধারাবাহিকতায় নাসিমা হায়দার এবং ইসমাত জাহান রাষ্ট্রদূত হন। ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা ইসমাত জাহান দীর্ঘ সময় নিউ ইয়র্ক এবং ব্রাসেলসে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। পরে সরকারের কাছ থেকে ছুটি (লিয়েন) নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইসলামী সহযোগিতা সংস্থা ওআইসির দূত হিসেবে কাজ করেন ইসমাত জাহান। তারপর মাজেদা রফিকুন্নেছা রাষ্ট্রদূত হন।
৮৬ সালে ফরেন সার্ভিসে যোগ দেওয়া পেশাদার কূটনীতিক রাবাব ফাতিমা জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী প্রতিনিধি থাকাকালে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি), স্থলবেষ্টিত উন্নয়নশীল দেশ (এলএলডিসি) ও ক্ষুদ্র দ্বীপপুঞ্জের উন্নয়নশীল দেশের (এসআইডিএস) জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ পান। ২০২৩ সালে অবসরে যাওয়া এই নারী কূটনীতিক এখনো জাতিসংঘের মহাসচিবের জ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত আছেন।
নবম ব্যাচের ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা রাষ্ট্রদূত মাশফি বিনতে শামস গত বছরের ডিসেম্বরে ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর থেকে অবসরে যান। হেড কোয়ার্টারে থাকাকালীন তিনি সম্ভবত প্রথম ‘নারী’ হিসেবে সচিব পদে নিয়োগ পান। রাষ্ট্রদূত মাশফি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সচিব (পূর্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিগত সরকারের সময়ে সচিব (পূর্ব) হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অবসরোত্তর ছুটিতে গেলে মাশফিকে দুই বছরের জন্য চুক্তিতে ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর করা হয়। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়ে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়ার পরও অন্তর্র্বতী সরকারের সময়ে পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব শেষ করে অবসরে যান সাউথ এশিয়ার এক্সপার্টখ্যাত সৎ ও দক্ষ অফিসার মাশফি।
পেশাদার কূটনীতিক সাইদা মুনা বাংলাদেশ পররাষ্ট্র সার্ভিসের ১১তম ব্যাচের কর্মকর্তা। যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ হাইকমিশনার থেকে গত বছরের ডিসেম্বরে অবসরে গেছেন। মুনা থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।
একই ব্যাচের আরেক পেশাদার নারী কূটনীতিক সুলতানা লায়লা হোসেইন পোল্যান্ডে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব শেষে অবসরে গেছেন।
এছাড়া, ১৩তম ব্যাচের ফরেন সার্ভিসের কর্মকর্তা রেজিনা আহমেদ গত বছরের ডিসেম্বরে অবসরে যান। তিনি সবশেষ পর্তুগালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন।