
সানজিদা মাহবুবা:
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের রিতু জীবনের নানা প্রতিবন্ধকতা উতরে বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস (বিজেএস) নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এবার বিজেএস পরীক্ষায় সারাদেশে মোট ৬০৩ জন উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর মধ্যে তিনি হয়েছেন ৯৭তম।
অথচ উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ারই সামর্থ তার ছিল না। উপায় না পেয়ে এগিয়ে আসলেন মা, গহনা বিক্রি করে সুগম করে দিলেন মেয়ের শিক্ষার পথ। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে শেষ করেন উচ্চ মাধ্যমিক জীবন। এরপর রিতু ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও প্রতিবন্ধকতা এসে দাঁড়ায়। তবু দমে যাননি তিনি, সেন্ট্রাল ফর যাকাত ম্যানেজমেন্ট (সিজেএম) বৃত্তির সহায়তায় তিনি পড়াশোনা চালিয়ে যান। কঠোর পরিশ্রম ও আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে ধাপে ধাপে স্বপ্নের পথে এগিয়ে যান। তিনবার ব্যর্থ হওয়ার পরও তিনি হাল ছাড়েননি, চতুর্থ বারেই ধরা দিল সাফল্য।
তার সফলতার পথে স্বামীও এক গুরুত্বপূর্ণ অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন। বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হলে, তিনি তাকে সাহস, মনোবল ও উৎসাহ প্রদান করেন। এভাবেই রিতুর অনুপ্রেরণামূলক জীবনের গল্প তুলে ধরেছেন ইত্তেফাক পত্রিকার ক্যাম্পাস প্রতিনিধি আনিসুর রহমান।।
ইত্তেফাক: ১৭তম বিজেএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ায় আপনাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনার জন্ম, শৈশবকাল সম্পর্কে জানতে চাই?
রিতু: আমার জন্মসাল ১২ অক্টোবর ১৯৯৭ সালে। আমার বেড়ে উঠা সিরাজগঞ্জ জেলার বেলকুচি থানার অন্তর্গত বয়ড়াবাড়ী গ্রামে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে আমি দ্বিতীয়। ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর ১৬তম বিজেএস পরীক্ষার দেওয়ার সময় বাবা মারা যান। আমি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি গ্রামের একটি স্কুলে। ২০১৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। এরপর শুরু হয় জীবন যুদ্ধ। কলেজে ভর্তি হওয়ার টাকা নেই, মায়ের গহনা বিক্রি করে রাজশাহী নিউ গভমেন্ট ডিগ্রী কলেজে ভর্তি হই। ২০১৫ সালে উচ্চ মাধ্যমিকে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই। এরপর ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে পড়ার সুযোগ পাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুরু হয় স্ট্রাগল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়াশোনা চালিয়েছি সেন্ট্রাল ফর যাকাত ম্যানেজমেন্টের (সিজেএম) টাকা দিয়ে। আমি ছোটবেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি বাড়ির সকল কাজে মা-বাবা কে সাহায্য করেছি। কোনো কাজকে কখনোই ছোট মনে করিনি।
ইত্তেফাক: এখন তো আপনি সহকারী জজের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। আপনার এ অনুভূতিটা সম্পর্কে বলুন।
রিতু: সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষা সন্দেহাতীতভাবে একটি কঠিন পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর জীবনের যত অপ্রাপ্তি ও ব্যর্থতার কষ্ট ছিল তা দূর হয়ে গেছে। তবে এই সফলতায় সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হতেন আমার বাবা যিনি এ পৃথিবীতে আর নেই। বাবার শূন্যতায় এই প্রাপ্তি অপূর্ণই রয়ে গেলো।
ইত্তেফাক: বিচারক হওয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা কে, কীভাবে এ স্বপ্নের শুরু হয়েছিল?
রিতু: ছোটবেলা থেকে নির্দিষ্ট কিছু হওয়ার স্বপ্ন না থাকলেও লেখাপড়া করে মানুষের মতো মানুষ হতে হবে এই লক্ষ্য সামনে রেখেই জীবনের প্রতিটি ধাপে এগিয়েছি। আইন বিভাগে ভর্তি হওয়ার পর বিভাগের বড় ভাই-আপুদের জজ হতে দেখে ইচ্ছে হলও আমিও জজ হবো। আব্বা-আম্মা আমাকে খুব উৎসাহ দিতেন। প্রতি ওয়াক্ত নামাজে আমার জন্য দোয়া করতেন। আমার ব্যর্থতায় সান্ত্বনা দিতেন। আবারো লেখাপড়া করার উৎসাহ দিতেন। আমার ভাইয়েরা পরামর্শ দিয়ে সবসময় আমার পাশে ছিলেন।
ইত্তেফাক: বিচারক হওয়ার স্বপ্ন কখন থেকে? বিচারক হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
রিতু: ছোটবেলা থেকেই আমাদের ৫ ভাই-বোনের লেখাপড়ার প্রতি আমার আব্বা-আম্মা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সদস্য হওয়ায় ঈদে কখনো নতুন জামা না পেলেও বই বা টিউশন ফি সবসময় আম্মা যোগাড় করে রাখতেন। আব্বা-আম্মার পরিশ্রম, সততা, দূরদর্শিতা, ধৈর্য্য সবকিছুই আমার বিচারক হওয়ার পেছনে অবদান রেখেছে। আম্মা বলতেন প্রয়োজনে রক্ত বিক্রি করে তোমাকে পড়াবো তবুও তুমি হাল ছেড়ো না। ২০২০ সালে অনার্স ৪র্থ বর্ষে আমার বিয়ে হয়। মূলত তখন থেকেই জজ হওয়ার জন্য লেখাপড়া শুরু করি।
আমার স্বামীও আইনের ছাত্র হওয়ায় দুজন আলোচনা করে আইন পড়তাম। কঠিন বিষয়গুলো সে খুব সহজ করে বুঝিয়ে দিতেন। সে আইনের নোট করতেন আর আমি জেনারেল বিষয়ের নোট করতাম। লেখাপড়ার পাশাপাশি সে আমাকে মানসিকভাবেও বিচারক হিসেবে প্রস্তুত করেছেন। যেমন একটা ঘটনা বলি রান্না করতে গিয়ে হাত কেটে বা পুড়ে গেলে সে বলতেন, ‘তোমার এই হাত শুধু কলম ধরার জন্যই উপযুক্ত’। অতিরিক্ত কষ্টের মুহূর্তে কুরআনের আয়াত পড়ে সে আমার মধ্যে আশা জাগিয়েছেন। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি তাদের সাধ্যের মধ্যে সর্বোচ্চ সহায়তা করেছেন।
ইত্তেফাক: আপনার সাফল্যের পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে?
রিতু: আমি মনে করি বিচারিক পেশায় আশার জন্য শুধু লেখাপড়া করলেই হবেনা বরং হতে হবে কৌশলী। আল্লাহ তাআলার ওপর ভরসা রেখে সঠিক দিকনির্দেশনায় থেকে সর্বোচ্চ পরিশ্রম করতে হবে। সেইসঙ্গে ধৈর্য্য, মানুষিক স্থিরতা, সততা, বিনয়, সহনশীলতা ও কথাবার্তায় স্পষ্টতার মতো মৌলিক মানবীয় বিষয়গুলোর চর্চা করতে হবে এবং আফসোস ও অহংকার করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শেষ সময়ে এই বিষয়গুলোর ওপর আমি বেশ গুরুত্ব দিয়েছি।
ইত্তেফাক: অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার সঙ্গে জুডিসিয়ারির পড়া কীভাবে সামলে নিয়েছেন?
রিতু: জুডিসিয়ারি পরীক্ষায় ৬০% প্রশ্ন সরাসরি আইন থেকে হয় আর সে আইনগুলোই আমরা ৪ বছরের অনার্স কোর্সে পড়ে থাকি। তাই অ্যাকাডেমিকে বাড়তি চাপ না নিয়ে আইনগুলো বুঝে বুঝে পড়েছি ও কিছুটা নোট করে মুখস্থ রাখার চেষ্টা করেছি।
ইত্তেফাক: কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন, দিনে কত ঘণ্টা করে পড়ালেখা করেছেন?
রিতু: প্রস্ততির শুরুটা ছিল হাতের লেখা ঠিক করার মধ্য দিয়ে। আমার লেখা এতটাই খারাপ ছিল যে কি লিখেছি তা বোঝাই যেতো না। খাতায় মার্জিন টেনে অ,আ,ক,খ লিখতাম। যাদের লেখা সুন্দর তাদের খাতা এনে সেইভাবে লেখার চেষ্টা করতাম আর নিজে নিজে বলতাম লেখা সুন্দর করতে পারলে জজও হইতে পারব।
প্রতিটি আইনের প্রিলি ও রিটেনে জন্য আলাদা আলাদা নোট করে পড়েছি। প্রতিটি বিষয়ের খুঁটিনাটি বুঝেবুঝে পড়েছি এবং বারবার রিভিশন করেছি। বুঝে পড়ার পাশাপাশি মুখস্থ করার ওপর ও বেশ গুরুত্ব দিয়েছি।
পড়ার সময় অন্যকোনো দিকে মনোযোগ দিতাম না। ফোন বালিশের নিচে রেখে দিতাম। ঘণ্টা ধরে কখনো পড়িনি তবে রুটিন করে প্রতিদিনের টার্গেট পড়া নিতাম এবং যতসময়ই লাগুক তা শেষ করতাম। এতে গড়ে দিনে ৮-১০ ঘণ্টা পড়া হতো।
ইত্তেফাক: কতবার ভাইভা দিয়েছেন এবং কততম ভাইভাতে সফল হয়েছেন? আপনি তিনবার ব্যর্থ হয়েছেন? হতাশা হয়েছেন কি?
রিতু: ১৪-১৭তম বিজেএসে মোট চারবার অংশ নিয়েছি এতে ১৪, ১৬ এবং ১৭ বিজেএস এ মোট তিনবার ভাইভা দিয়েছি। ১৭তম বিজেএস এর ভাইভাতে উত্তীর্ণ হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। তিন বার ভাইভা দিয়েছি, একবার প্রিলি থেকে বাদ পড়েছি। ৩য় ভাইভাতে সফল হয়েছি। হতাশা এসেছে, এটা আসবেই, সেই সময়ে কুরআন থেকে শিক্ষা নিয়েছি। আমার স্বামী (তাওহিদুল ইসলাম) হাফেজ হওয়ায় সে সব সময় কুরআন থেকে বিভিন্ন আয়াত ব্যাখ্যা করে আমার ঈমান বৃদ্ধিতে সাহায্য করতেন। কোনো মুমিন মুসলিম আল্লাহর সাহায্য থেকে নিরাশ হতে পারে না। রিজিক তো আসমান থেকে ফয়সালা হয় তাই হতাশার সময় আমি রিজিকের মালিক আল্লাহু তাআলার কাছেই সাহায্য চেয়েছি এবং প্রচুর দোয়া করেছি।
ইত্তেফাক: বিচারক হিসেবে দেশের জন্য আপনি কি অবদান রাখতে চান?
রিতু: সততা ও ধৈর্যের সঙ্গে বিচারিক দায়িত্ব পালন করে জনগণের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে চাই।
ইত্তেফাক: ভাইবার সময় কোনো বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে, আপনি কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
রিতু: প্রিলি এবং রিটেনের পড়াগুলো রিভিশন করতে হবে, স্পষ্ট ও যথাসাধ্য শুদ্ধ ভাষায় গুছিয়ে কথাবলার অভ্যাস করতে হবে। মক ভাইভা দিতে পারলে ভালো হয়। যেকোনো পরিস্থিতিতেই মানসিকভাবে স্থির থাকতে হবে এমনকি ভাইভা বোর্ড থেকে অপমান করে বের করে দিলেও নার্ভাস হওয়া যাবে না, না খেয়ে বা খালি পেটে ভাইভা বোর্ডে যাওয়া যাবে না। লিখিত পরীক্ষায় পাশ করার পর আমার আম্মা ও স্বামীর কাছে ভাইভা দিতাম। আম্মা আমার কথা বলার ধরণ ও আই-কন্টাক্ট ঠিক করে দিতেন আর স্বামী আইনের ভুল ঠিক করে দিতেন।
ইত্তেফাক: যারা বিচারক হতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
রিতু: লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে কারণ লিখিত পরীক্ষার নাম্বারের ওপরেই চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করে। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বিষয় অনেকেই মনে করেন বাংলা, ইংরেজি বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে তেমন প্রস্ততি না নিয়ে পরীক্ষার হলে বানিয়েই লেখা যাবে এটা একদমই ভুল ধারণা। বরং আগে থেকেই রচনা, ভাব-সম্প্রসারণ, ব্যাকরণের মত বিষয়গুলো বারবার প্র্যাকটিস করতে হবে। আর বাংলাদেশ-আন্তর্জাতিক বিষয়ের জন্য এলোমেলো অনেক বই না পড়ে বিসিএস এর কোনো লিখিত বই থেকে বিষয়ভিত্তিক বিস্তারিত পড়তে হবে এবং বিশ্বের চলমান ঘটনার প্রতি নজর রাখতে হবে। অনেকেই আমার মতো ইংরেজিতে খুব দুর্বল তাদের বলব বিসিএস ও বিজেএস এর লিখিত পরীক্ষার প্রশ্নগুলো বারবার প্রাকটিস করতে। জুডিসিয়ারির প্রশ্নগুলো বারবার বিশ্লেষণ করে গুরুত্বপূর্ণ টপিক গুলোর ওপর বেশি জোর দিতে হবে।
ইত্তেফাক: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
রিতু: ডেইলি ইত্তেফাকেও ধন্যবাদ। যারা জুডিসিয়ারির প্রস্ততি নিচ্ছেন তাদের জন্য অনেক শুভকামনা রইলো। সবাই দোয়া করবেন আমি যেন ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় নিরলসভাবে কাজ করতে পারি।