‘কয়েকটি দল নাগরিক সেবার চেয়ে রাজনৈতিক স্বার্থকে বড় করে দেখছে’

ইত্তেফাককে একান্ত সাক্ষাৎকারে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ

প্রকাশিত: ১২:১৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ১০, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিলেন আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি অন্তর্র্বতী সরকারে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন। বর্তমানে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন। জুলাই অভ্যুত্থান, রাষ্ট্র সংস্কার এবং দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শনিবার তিনি কথা বলেছেন দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবির হাকিম।

দৈনিক ইত্তেফাক: আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছেন। সরকার পরিচালনায় কি তেমন সহযোগিতা ও সমর্থন পাচ্ছেন? গণমানুষ কি এই সরকারের ওপর সন্তুষ্ট?

আসিফ মাহমুদ: আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও সরকার পরিচালনার প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময় সারা দেশের মানুষ দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ফ্যাসিবাদকে হটাতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। বিপ্লবোত্তর সময়ে ভঙ্গুর প্রশাসন ও পুলিশসহ আমরা একটি ভিন্ন পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নিয়েছি। অভ্যুত্থানের ফলে মানুষের মনে যে আশার সঞ্চার হয়েছিল, সেটা আমরা সব অংশে পূর্ণ করতে পারিনি, তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি।

কিন্তু সরকারবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা এবং রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার নানা ইস্যু মোকাবিলায় জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সরকারকে সহযোগিতা করছে। তার মানে জনগণের সহযোগিতা সরকারের সঙ্গে ছিল এবং আছে। তবে অভ্যুত্থানের সব অংশীদার সরকারকে সহযোগিতা করছে, এমনটা আমি মনে করি না। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, গণঅভ্যুত্থানের অনেক অংশীদারই এখন তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ভিন্ন মেরুতে অবস্থান নিচ্ছে। এমনকি নানা প্রোপাগান্ডাকেও বড় রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে ফ্যাসিলিটেট করা হয়েছে। আমাদের আহ্বান থাকবে, জাতীয় স্বার্থে একতা গুরুত্বপূর্ণ-এদিকে তারা মনোযোগ দেবে।

ইত্তেফাক: আপনারা যারা একসঙ্গে আন্দোলন করেছিলেন, আপনার সহযোদ্ধারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছেন। এ দলের গঠন বা পরিচালনায় আপনার কোনো ভূমিকা আছে কি না? নতুন এই রাজনৈতিক প্ল্যাটফরমকে কীভাবে দেখছেন?

আসিফ মাহমুদ: নতুন রাজনৈতিক দলের গঠন বা পরিচালনায় আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। শুরু থেকেই যেহেতু এই সরকারের ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনের (গণতন্ত্রে উত্তরণ) গুরুদায়িত্ব আছে, সে জায়গা থেকে শুরু থেকেই এটা স্পষ্ট করেছি যে, কোনো উপদেষ্টা যদি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে চান, তাহলে তাকে তার ওপর সরকারের অর্পিত দায়িত্ব ছাড়তে হবে। অন্তর্র্বতী সরকারের একজন উপদেষ্টা তার পদ ছেড়ে দিয়েই কিন্তু নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দিয়েছেন। ভবিষ্যতে যদি আমি কখনো এর অংশ হই, তাহলে বর্তমান দায়িত্ব ছেড়েই সেটি করব। তবে নতুন রাজনৈতিক দলটি দেশের গণতান্ত্রিক চর্চায় নতুন দ্বার উন্মোচিত করবে বলে প্রত্যাশা থাকবে। শুধু নতুন রাজনৈতিক দল নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে, এমনটা প্রত্যাশা করি।

ইত্তেফাক: রাজনৈতিক দলগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়েও আলোচনা উঠেছিল। দলগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের অবস্থান কী?

আসিফ মাহমুদ: কয়েকটি রাজনৈতিক দল দ্রুত নির্বাচনের কথা বলছে। আবার অনেকেই অর্থবহ সংস্কারের পর নির্বাচনের কথা বলছে। তবে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার সংস্কারের ব্যাপারে বদ্ধপরিকর। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, যদি রাজনৈতিক দল দ্রুত সংস্কারের ক্ষেত্রে সহযোগিতা করে, তাদের মতামত দেয়, সেক্ষেত্রে দ্রুত নির্বাচন সম্ভব হবে। আর যদি গড়িমসি করে তাহলে নির্বাচন বিলম্বিত হতে পারে। তবে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) তো একটি টাইম লাইন দিয়েছেন, এ বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুন পর্যন্ত। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়ে কথা উঠেছে, কারণ স্থানীয় সরকার অকার্যকর থাকায় মানুষ দৈনন্দিন নানা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সমস্যা পোহাচ্ছে। দুই-একটি দলের বিরোধিতা থাকলেও অধিকাংশ দল স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে চায়। এ বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি, আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।

ইত্তেফাক: রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্দেশ্যে যেসব সংস্কার কমিশন হয়েছে তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী কতটা সংস্কার করা সম্ভব বলে মনে করছেন? রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে, এক্ষেত্রে সংস্কার বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন কিনা?

আসিফ মাহমুদ: রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন যেটি গঠিত হয়েছে ড. ইউনূস স্যারের সভাপতিত্বে; সেই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করবে। কতটুকু সংস্কার তারা চান, কতটুকু চান না তার ভিত্তিতে, স্টেক হোল্ডার কনসালটেশনের (অংশীজনদের মতামত) ভিত্তিতে আমরা বুঝতে পারব কতটুকু সংস্কার করা যাবে। আমার মনে হয়, শাসনতান্ত্রিক সংস্কার ছাড়া অন্য সংস্কার বা আইন সংশোধন করতে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়। ঐকমত্য কমিশনের নির্দেশনা পেলেই মন্ত্রণালয়গুলো সংস্কারের কাজ বাস্তবায়ন শুরু করবে।

ইত্তেফাক: সরকার নির্বাহী আদেশে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করলেও আওয়ামী লীগের বিচারের প্রশ্নে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীও বিভিন্ন দলে ভিড়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। নতুন বাস্তবতায় আওয়ামী লীগ কি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হতে পারে?

আসিফ মাহমুদ: সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে। একইভাবে বিচারিক প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত হলে আওয়ামী লীগের জন্যও সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন। জুলাই অভ্যুত্থানে তারা যে গণহত্যা ঘটিয়েছে, সে বিষয়ে এখনো তারা ক্ষমা চায়নি এবং বিচারও সম্পন্ন হয়নি। বিচারের আগে কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়া উচিত না বলে একজন নাগরিক হিসেবে আমি মনে করি। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত বিচারের আগে আদালত বা ট্রাইব্যুনাল আমাদের একটা প্রস্তাব দিতে পারে।

ইত্তেফাক: দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন জায়গায় মব তৈরি করে সুবিধা নিলেও তাদের অনেকে বিচারের আওতায় আসছে না। এমনটা কেন হচ্ছে বলে মনে করেন?

আসিফ মাহমুদ: বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে আমাদের পুলিশ প্রশাসন ভঙ্গুর অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে ক্রমাগত উন্নতির দিকে যাচ্ছে, তবে সেটা আশানুরূপ নয়। একটা বাহিনীকে নতুন করে সাজানো দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বিষয়। তবে সব উদ্যোগ সরকার নিয়েছে। শিল্পির এর সমাধান হবে বলে আমি মনে করি। এ অবস্থায় সব পক্ষকে ধৈর্যের সঙ্গে কাজ করা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহযোগিতা করার আহ্বান থাকবে।

ইত্তেফাক: স্থানীয় সরকারে দীর্ঘদিন জনপ্রতিনিধি না থাকায় নাগরিকরা মৌলিক সেবা পেতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন। এটি কবে নাগাদ স্বাভাবিক হবে?

আসিফ মাহমুদ: স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিষয়টি তো বললাম, তবে নাগরিক বিড়ম্বনার বিষয়টি সমাধান করা আমাদের মূল লক্ষ্য। কয়েকটি রাজনৈতিক দল নাগরিক বিড়ম্বনার বিষয়টি নজরে নিচ্ছে না, তারা রাজনৈতিক স্বার্থকে বড় করে দেখছে। যে কারণে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে বাধার সৃষ্টি হচ্ছে। এমতাবস্থায় যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে নির্বাচন হবে, আর যদি সম্ভব না হয় সেক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার প্রশাসক নিয়োগের মাধ্যমে নাগরিক বিড়ম্বনা কাটিয়ে উঠার জন্য কাজ করব।