‘দেশের ক্রিকেটে উন্নতি হচ্ছে না’

সাক্ষাৎকারে লিটন

প্রকাশিত: ২:৩১ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০২৫

ক্রীড়া ডেস্ক:

 

গত বছর সাদা বলের ক্রিকেটে খুব একটা ভালো খেলা হয়নি লিটন কুমার দাসের। যে কারণে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মতো গুরুত্বপূর্ণ টুর্নামেন্টের দলে জায়গা হয়নি তাঁর। বিপিএলে ভালো করেও নির্বাচকদের মন গলাতে পারেননি। এখানেই শেষ না, ঘরোয়া ক্রিকেট ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) ভালো দল থেকে ডাক পাননি। এই হতাশার দিন পেছনে ফেলে এ বছর জাতীয় দলে ভালো খেলতে চান উইকেটরক্ষক এ ব্যাটার। পঞ্চপাণ্ডবের উত্তরসূরি হিসেবে দেশের ক্রিকেটে অবদান রাখতে চান। ঘরোয়া ক্রিকেট, জাতীয় দল ও সোশ্যাল মিডিয়ার নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে লিটন কুমার দাসের মনখুলে বলা কথা শুনেছেন সেকান্দার আলী

* ঢাকা লিগে নতুন একটি দলে খেলতে কেমন লাগছে?
লিটন: প্রিমিয়ার লিগে খেলতে ভালোই লাগছে। নতুন দলে খেলছি। অধিকাংশ জুনিয়র খেলোয়াড়। কয়েকজন সিনিয়র ক্রিকেটার আছেন। মিলেমিশে খেলতে ভালোই লাগছে। এটাও সত্য, খুবই হতাশ বাংলাদেশের ক্রিকেট ক্লাবগুলো নিয়ে। কারণ, দিন দিন নিচের দিকে যাচ্ছে।

* আপনি বড় দলে খেলে অভ্যস্ত ছিলেন। হঠাৎ নবাগত দলে খেলতে হওয়ায় মনে কি খুব কষ্ট?
লিটন: বলব না কষ্ট লাগছে; যেটা বললাম, বাংলাদেশের ক্রিকেটের উন্নতি হচ্ছে না। ভালো খেলায়াড়রা ভালো দল পাচ্ছে না। অনেক খেলোয়াড় প্রথম দিকে দল পায়নি। শুনতে খারাপ লাগবে, কিন্তু বাস্তবতা হলো ক্লাবগুলো নিচের দিকে যাচ্ছে। এটা শুধু ক্লাব ক্রিকেট না, বিপিএলেও একই ঘটনা ঘটেছে। অনেক ক্রিকেটার আছে, যারা আইকন হিসেবে দলভুক্ত হওয়ার যোগ্য অথচ তারা দল পেয়েছে অনেক পরে। যারা একদম নতুন, তারা ‘রিটেইন’ প্লেয়ার হয়ে গেছে। এ থেকে বোঝা যায়, আমাদের ক্রিকেটের মান কোন দিকে যাচ্ছে। যারা ক্লাব বা দল চালায়, তারা কীভাবে চিন্তা করছে।

* এটা কি ‘সিস্টেমের’ দোষ?
লিটন: আমি আসলে কাউকে দোষ দেব না। তবে এটা হওয়া উচিত না। খেলোয়াড় হিসেবে আমার কাজ ভালো খেলে ভালো জায়গায় যাওয়া। আমি যদি ভালো পারফরম্যান্স করি আর ভালো জায়গায় না যেতে পারি, তাহলে বুঝব কোথাও ঘাটতি আছে।

* এই লিগে ৫০ হাজার টাকায় খেলতে হচ্ছে অনেককে। কতটা কষ্টের?
লিটন: এটা খুবই হতাশাজনক। বাংলাদেশে জাতীয় দলের পর সবচেয়ে বড় দুটি ইভেন্ট হলো বিপিএল ও ডিপিএল। বিপিএল সবাই খেলে না। বেশি খেলে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। এখান থেকে আমাদের ওয়ানডে দলের ক্রিকেটার বাছাই করা হয়। ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম। এত বড় একটি মঞ্চে ৫০ হাজার টাকায় একজন খেলোয়াড় খেলছে, খুবই খারাপ অভিজ্ঞতা। এই বাজারে ৫০ হাজার টাকা কিছুই না। এক মাসের বাজারও হয় না। কেন একজন খেলোয়াড় ৫০ হাজার টাকার জন্য এত অ্যাফোর্ট দেবে? ১১টি ম্যাচ খেলবে? আমরা সবাই বলি, ক্রিকেট ভালোবেসে খেলি; কিন্তু পেশার জায়গা তো বাদ দিতে পারবে না। আপনি সচ্ছল না থাকলে ক্রিকেট খেলবেন কেন? একটি ছেলেকে ক্রিকেট খেলতে গেলে তাকে ফিটনেস করতে হয়, জিম করতে হয়, যাতায়াত আছে। এসবের জন্য তাকে খরচ করতে হয়। এত কিছু করার পর কেন সে ৫০ হাজার টাকায় খেলবে। আমার মনে হয়, এটা আপগ্রেড হওয়া উচিত।

* বিপিএলে উইকেট ভালো ছিল, রান হয়েছে। কিন্তু ব্যাটাররা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে গিয়ে ভালো করতে পারল না কেন?
লিটন: খেলোয়াড় হিসেবে বলছি, আমাদের গ্রুপটা কী ছিল? ডেথ গ্রুপ। আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি– বাংলাদেশ দল জিতবে, সেমিফাইনাল, ফাইনাল খেলবে। প্রত্যাশা একরকম, বাস্তবতা ভিন্ন। বাংলাদেশ যে গ্রুপে দুটি ম্যাচ খেলে হেরেছে, সেই দুটি দলই চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির চ্যাম্পিয়ন এবং রানার্সআপ। কাদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলছেন এই জিনিসটি মাথায় নিতে হবে। বিশ্ব ক্রিকেটে গত পাঁচ বছর ধরে ভারত ডমিনেন্ট করছে। এই সময়ে রেকর্ড দেখা হলে উপমহাদেশে নিউজিল্যান্ড খুব ভালো ক্রিকেট খেলছে এশিয়ার বাইরের দলগুলোর মধ্যে। আপনি তাদের বিপক্ষে খেলে হেরেছেন। তারা খুবই পরিকল্পিত একটি দল। সবকিছু পরিকল্পনামাফিক খেলে। তাদের বিপক্ষে ম্যাচ জিততে হলে ১১ জন ক্রিকেটারকে শতভাগ দিয়ে খেলতে হবে। কারণ প্রতিপক্ষ দলের সবাই শতভাগ দিয়ে ম্যাচ খেলে। তারা নিয়মিত পারফরমার। এই জিনিসটি মানতে হবে, যে দুটি দলের সঙ্গে খেলেছে, তারা অনেক শক্তিশালী। তাদের সঙ্গে ওই দিন যদি শতভাগ দিয়ে ক্রিকেট খেলতে না পারি, তাহলে হারব এবং সেটাই হয়েছে।

* চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি খেলতে না পারা কতটা কষ্টের ছিল লিটনের জন্য?
লিটন: প্রত্যেক খেলোয়াড় চায় জাতীয় দলের হয়ে খেলবে। আইসিসির মতো বড় একটি টুর্নামেন্টে খেলার ইচ্ছা এবং লক্ষ্য আমারও ছিল। দুঃখজনক হলো তা হয়নি। এটা জীবনেরই অংশ। আপনি কোনো সময় ভালো করবেন, কোনো সময় ভালো করবেন না। এই না খেলতে পারা যতটা না কষ্টের, তার চেয়ে বেশি বুঝতে পেরেছি আমাকে কোথায় উন্নতি করতে হবে।

* সাদা বলের ক্রিকেটে আপনার আউটের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন নির্বাচকরা। আপনি কি সে জায়গায় উন্নতির জন্য কাজ করছেন?
লিটন: চেষ্টার কমতি কোনো দিনই ছিল না। কোনো দিন রান পেয়েছি, কোনো দিন পাইনি। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রত্যেক খেলোয়াড়ই তো নিয়মিত রান করেনি। কিন্তু আমি রান না করলে জিনিসটা বেশি খারাপ হয়ে যায়। আমি চেষ্টা করি, সবখানে রান করতে। হয়নি বলেই আমি দলের বাইরে। আবার চেষ্টা করব, পারফরম্যান্স করে দলে ঢুকতে।

* লিটন যখন খেলে তাঁর ব্যাটিং ছবির মতো থাকে। বিপিএলে বেশ কয়েকটি ইনিংসে আপনাকে ছবির মতো ব্যাটিং করতে দেখা গেছে। সে জায়গা থেকে কতটা আত্মবিশ্বাস নিতে পেরেছেন?
লিটন: এই যে কথাটা বললেন, এটাই আমার জন্য নেতিবাচক। কারণ, সবাই ভাবে আমি মাঠে গেলেই রান করব। কেউ রান করুক বা নাই করুক, আমাকে রান করতে হবে। কিন্তু আমি তো মানুষ, ফেল হতেই পারি। আমার খেলা সুন্দর দেখে প্রতিদিন রান করব, তা না। একজন বোলারের একটি ভালো বলে আউট হতেই পারি। একটি ভালো ক্যাচ নিতে পারে বা আমি একটি বাজে শট খেলতে পারি; কারণ আমি মানুষ। আমার ব্যাটিং সুন্দর দেখে প্রতিদিন রান করতে হবে, এই জিনিসটি সবার ভেতরে গেঁথে গেছে। যারা নিউজ পোর্টাল চালায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় রিলস বানায়, তাদের উপস্থাপনায় থাকে আমি কেন রান করছি না। আমাকে নিয়ে দিনের পর দিন তারা কনটেন্ট বানিয়েই যাচ্ছে।

* এই কনটেন্ট ক্রিয়েট ও ভিউ মিডিয়া কি চাপ তৈরি করছে?
লিটন: জিনিসটা চাপের না, খুবই ‘হ্যাম্পার’ করে। যেভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জিনিসগুলো যাচ্ছে, কনটেন্ট ক্রিয়েটর বা ইউটিউবার যাদের কথাই বলেন না কেন, তাদের অধিকার আছে নিউজ বানানোর। কিন্তু সেগুলোর তো নৈতিক জায়গা থেকে হচ্ছে না। আমার মনে হয়, বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খুবই নেতিবাচক বার্তা দিচ্ছে কনটেন্টগুলো। আমাদের জন্যও অনেক ক্ষতি হচ্ছে। কারণ, তারা সেই জিনিসটা দেখাচ্ছে বাস্তবে যেটা গুরুত্বপূর্ণ না। আপনি সারাদিন প্র্যাকটিস করলে দু-তিনটা খারাপ হবেই। তিন ম্যাচ খেললে একটি খারাপ হতেই পারে। এখন সেই খারাপটাই যদি বারবার ফুটেজে দেখান, তাহলে কীভাবে হবে। কিছু সংখ্যক মানুষের জন্য এটা প্লাস পয়েন্ট। কিছু সংখ্যক মানুষের জন্য এটা হতাশাজনক।

* কাদের জন্য প্লাস পয়েন্ট?
লিটন: তাদের কাছে এগুলো ভালো নিউজ, বেশি ভিউ হয়। মানুষ এগুলোই খায়।

* এ বছর জাতীয় দলের অনেক খেলা। নিজেকে কোন জায়গায় দেখতে চান?
লিটন: আমার চেষ্টা সব সময় যে রকম থাকে, এ বছরও তাই থাকবে। আলাদা কিছু করার ইচ্ছা আমার নেই। যেভাবে ক্রিকেট খেলি, সেভাবে খেলব এবং চেষ্টা করব পারফরম্যান্স করার।

* আপনাদের আগের জেনারেশন পঞ্চপাণ্ডবের বিদায় নিয়ে জানতে চাই। তাদের উত্তরসূরি হিসেবে কী নিতে পেরেছেন বা তারা কী দিয়ে যেতে পেরেছেন?
লিটন: আমি পাঁচজন সিনিয়র ক্রিকেটারের অধীনেই খেলেছি। সবচেয়ে বেশি মুশফিক ভাই খেলেছেন। তিনি টেস্টে ২০ বছর ধরে আছেন। আমার মনে হয়, তিনি আমাদের আদর্শ। অনেক ক্রিকেটারের মোটিভেটর। শুধু কথাবার্তায় না, ওয়ার্ক এথিকসের দিক থেকে। অনেক খেলোয়াড় তাঁকে দেখে প্র্যাকটিসে পরিশ্রম বাড়িয়েছে। প্রত্যেক খেলোয়াড়ের ভালো-খারাপ সময় যায়। এই জিনিসটি যত দ্রুত বুঝতে পারবে, তার জন্য ততই মঙ্গল। আমার মনে হয় মুশফিক ভাই, রিয়াদ ভাই, সাকিব ভাই, তামিম ভাই, মাশরাফি ভাই দেশের জন্য অনেক কিছুই দিয়েছেন। এখন আমাদের পালা আমরাও চেষ্টা করব দেওয়ার জন্য। মুশফিক ভাই যেহেতু এখনও আছেন, চেষ্টা করব কিছু ভালো ইনিংস রিপিট করতে।

* টি২০ দলের নেতৃত্ব নিয়ে কথা হয়েছে?
লিটন: না, এখন পর্যন্ত কোনো কথা হয়নি। এ ব্যাপারে কোনো কিছু জানি না।

* নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য আপনি প্রস্তুত?
লিটন: হ্যাঁ, আমাকে দিলে অবশ্যই করব। না করার কিছু নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজে শেষ সিরিজেও ক্যাপ্টেন্সি করেছি।