
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
রাজধানীর বনশ্রীতে ব্যবসায়ীকে কুপিয়ে ও গুলি করে স্বর্ণ ছিনতাইকারীদের চক্রে আছে অন্তত ২০ জন। তাদের কেউ ৩৫ বছর, কেউ ১৫ বছর ধরে ছিনতাই-ডাকাতি করছে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার স্বর্ণের দোকান ও স্বর্ণ আনা-নেওয়া করে এমন ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করে ছিনতাইয়ের ছক আঁকে। বনশ্রীর ঘটনার আগেও তারা রেকি করেছিল দু’দিন। ঘটনার সময় ‘ব্যাকআপ’ গ্রুপ প্রস্তুত রাখা ছিল।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ছিনতাইয়ে সরাসরি অংশ নেয় সাতজন। যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের মধ্যে তিনজন সরাসরি অংশ নিয়েছিল। তারা হলো– দলনেতা কাওসার সিকদার এবং সহযোগী আমিনুল ইসলাম ও সুমন। অন্য তিনজন– খলিলুর রহমান, ফরহাদ আলী ও দুলাল চৌধুরী। তারা ছিনতাইয়ের ঘটনায় অন্য দায়িত্ব পালন করে। তিনটি মোটরসাইকেলে সাতজন এসেছিল। মোটরসাইকেলে নম্বর প্লেট ছিল না। তাদের আরেকটি দল রামপুরা বিটিভি ভবনের সামনে সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে অবস্থান করছিল। স্বর্ণ ছিনতাই করে ওই সাতজন মোটরসাইকেলে চলে যায় বিটিভি ভবনের সামনে। সেখানে আগে থেকে অবস্থান করা লোকজনের সঙ্গে চারজন অটোরিকশায় উঠে যে যার বাসায় চলে যায়। অন্য তিনজন মোটরসাইকেল চালিয়ে তাদের বাসায় যায়। ছিনতাইয়ের এক সপ্তাহ আগে পরপর দু’দিন তাদের একটি দল বনশ্রীর সি ব্লকের ৫ নম্বর সড়কে ‘অলংকার জুয়েলার্স’ এবং এর মালিক আনোয়ার হোসেনের ডি ব্লকের ৭ নম্বর রোডে বাড়ির সামনে রেকি করে। আনোয়ার কখন দোকান বন্ধ করেন এবং কীভাবে কোন পথে বাসায় ফেরেন, সেসব অনুসরণ করেছিল তারা। এর পর চক্রের সব সদস্য মিলে আলোচনা করে ‘অপারেশনের’ সিদ্ধান্ত নেয়। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী গত ২৩ ফেব্রুয়ারি তারা ছিনতাই করে।
জড়িতদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানায় পুলিশ। তিন দিনের রিমান্ড শেষে গত বুধবার তাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। গ্রেপ্তারের সময় দুই ভরি স্বর্ণ, একটি রিভলবার ও একটি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়।
তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, এই চক্রের অন্তত ২০ জন ছিনতাই ও ডাকাতি করে। বিভিন্ন এলাকায় স্বর্ণের দোকান ও আশপাশে তারা রেকি করে। যেখানে ছিনতাই করে দ্রুত বের হয়ে যেতে পারবে, সেই এলাকা বেছে নেয় তারা। এই চক্রের বেশির ভাগ সদস্য আগে কেউ কাউকে চিনত না। বিভিন্ন সময় মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে গিয়ে পরিচয় হয় এবং পরে তারা চক্র গড়ে তোলে। গ্রেপ্তার হওয়া দু’জনের রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া গেছে। আমিনুল ইসলাম পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলার চর ওয়াডেল এলাকার বাসিন্দা এবং উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য। মো. সুমন একই ইউনিয়নের আয়নাবাজ গ্রামের বাসিন্দা এবং কালাইয়া ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সহদপ্তর সম্পাদক। দু’জনই আগে থেকে পেশাদার ডাকাত দলের সদস্য। আমিনুল ২০২৩ সালে প্রথমে গরু চুরির মামলায় পটুয়াখালীর দশমিনা থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়। ওই মামলায় জামিনে বেরিয়ে ডাকাত দলে যোগ দেয়। তার বিরুদ্ধে চুরি ও ডাকাতির চারটি মামলা আছে। লুণ্ঠিত স্বর্ণ কম মূল্যে কেনে চক্রের সদস্য গ্রেপ্তার হওয়া দুলাল চৌধুরী। ছিনতাই বা ডাকাতিতে সরাসরি অংশও নেয়। তার গ্রামের বাড়ি ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার চরসাহাভিকারী। তবে নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা এলাকায় বাস করে। ফতুল্লার ধর্মগঞ্জে তার স্বর্ণের দোকান ছিল। ২০২০ সালে দোকান বন্ধ করে দেয়। তার বিরুদ্ধে ডাকাতির অভিযোগে বিভিন্ন থানায় তিনটি মামলা আছে। অন্তত ১৫ বছর ধরে ডাকাতিতে জড়িত দুলাল।
চক্রটির দলনেতা কাওসার সিকদারের বিরুদ্ধে বরিশাল বাকেরগঞ্জ, পটুয়াখালীর দুমকী ও রাজধানীর কদমতলী থানায় তিনটি ডাকাতির মামলা আছে। তার কাছ থেকে পুলিশ একটি রিভলবার জব্দ করে। ২০১৬ সালে ডাকাতির ঘটনায় প্রথম কদমতলী থানা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছিল। তার বাড়ি পটুয়াখালী সদর উপজেলার ঠেংগাই গ্রামে। বাস করে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে।
গ্রেপ্তার ফরহাদ আলীর (৬১) বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলক্ষেত ও নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানাসহ বিভিন্ন থানায় আটটি মামলা আছে। ২৫ বছর বয়স থেকে ডাকাতি করছে বলে তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানতে পেরেছেন। বহুবার গ্রেপ্তার হয়েছে ফরহাদ। আরেক আসামি খলিলুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে প্রথম রাজধানীর শ্যামপুর থানায় ডাকাতি মামলা হয়। তার নামে মামলা আছে পাঁচটি।
বনশ্রীতে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের ঘটনায় আনোয়ারের স্ত্রী হোসনে আরা বেগম রামপুরা থানায় মামলা করেন। এতে ১৬০ ভরি স্বর্ণালংকার ও লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ করা হয়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১১টায় আনোয়ার বাসায় ফেরার সময় বাসার গেটের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। আহত হয়ে কয়েক দিন হাসপাতালে ছিলেন তিনি।
রামপুরা থানার ওসি আতাউর রহমান আকন্দ সমকালকে বলেন, স্বর্ণ লুটে জড়িত ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জড়িত অপর আসামিদের গ্রেপ্তার এবং লুণ্ঠিত স্বর্ণ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
বাউফল (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি জানিয়েছেন, ডাকাত দলের সদস্য হয়েও রাজনৈতিক দলে কীভাবে ঠাঁই হয়েছে আমিনুলের– এ প্রশ্নে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের এক নেতা অজ্ঞাত স্থান থেকে মোবাইল ফোনে সমকালকে বলেন, আমিনুল ডাকাত দলের সদস্য। সে ছাত্রলীগের সদস্য হতে পারে না। এত বড় সংগঠনের সভা-সমাবেশে যে কেউ ছবি তুলতে পারে। তবে পুলিশসহ বিভিন্ন সূত্র জানায়, আমিনুল স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে পরিচিত ও প্রভাবশালী।
শ্রমিক দলের নেতা মো. সুমন সম্পর্কে বাউফল উপজেলা শ্রমিক দলের আহ্বায়ক হাসান মাহমুদ মঞ্জু বলেন, ‘আমি সুমনকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কমিটিতে কীভাবে এলো বলতে পারছি না। তবে ইউনিয়ন শ্রমিক দলকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে তাকে বহিষ্কারের জন্য। তাকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।’