ঈদযাত্রায় ভোগাতে পারেন শ্রমিকরা

ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক

প্রকাশিত: ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ, মার্চ ১৮, ২০২৫

গাজীপুর প্রতিনিধি:

 

গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে উন্নয়নকাজ চলায় ঢাকা-টাঙ্গাইল ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হয়নি। সেসব কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সব রাস্তা ও ফ্লাইওভার খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে এবারও ঈদযাত্রায় স্বস্তির আশা নেই। গ্রামে যাওয়ার পথে ভোগান্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে গাজীপুরের শিল্পকারখানার শ্রমিকরা। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে, সেই আশঙ্কা তত বাড়ছে।

ঢাকার সঙ্গে উত্তর, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের সড়ক যোগাযোগ হয় গাজীপুরের মধ্য দিয়ে। ঈদে ৩৬টি জেলার মানুষকে বাড়ি যেতে হয় এই জেলার ওপর দিয়ে। ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে এরই মধ্যে প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। তবে তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ এনে দিচ্ছেন শিল্পকারখানার মালিক ও শ্রমিকরা।

ফেব্রুয়ারি-মার্চের বেতন ও ঈদ বোনাসের দাবিতে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ২৫ রোজা পর্যন্ত সময়সীমা বেঁধে দিয়েছে। ঈদের আগে এ দাবি কারখানা মালিকরা কতটা পূরণ করতে পারবেন, এর ওপর মহাসড়কের পরিস্থিতি নির্ভর করছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।

শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গতকাল সোমবার ভোগড়া বাইপাসে বেতন-বোনাসের দাবিতে একটি কারখানার শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে আসেন। তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের ১২টি কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শ্রীপুরে দুই মাসের বকেয়া বেতন, বোনাস ও কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে আঞ্চলিক সড়ক অবরোধ করেন শ্রমিকরা।

গত এক সপ্তাহে অন্তত ১২টি কারখানার শ্রমিক ঢাকা-ময়মনসিংহ ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বিক্ষোভ করেছেন। আর বকেয়া বেতনসহ নানা দাবি নিয়ে গত সাত মাসে (৫ আগস্টের পর) অন্তত ১০০ বার শ্রমিকরা এ দুই মহাসড়ক অবরোধ করেছেন।

মহানগরের ভোগড়া বাইপাস এলাকায় টিএনজেড গ্রুপের পাঁচটি ও কলম্বিয়ার দুটি কারখানা রয়েছে। প্রতি মাসে এসব কারখানার শ্রমিকরা মহাসড়কে নেমে আন্দোলন করার পর বেতন পরিশোধ করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।

কয়েকটি কারখানার শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যে কোনো উপায়ে তারা ফেব্রুয়ারির পুরো বেতন, মার্চের অর্ধেক বেতন ও ঈদ বোনাস পুরোটা নিয়ে বাড়ি যাবেন। এর ব্যত্যয় হলে আন্দোলন হবে।

টিএনজেড গ্রুপের একটি কারখানার শ্রমিক জাহেদুল ইসলাম গতকাল বলেন, ‘আমার বেতন-বোনাসের টাকার ওপর কতগুলো মানুষ নির্ভর করে জানেন? স্ত্রী-সন্তান, বাবা-মা, বাসার মালিক, বাকিতে যে দোকানি মালপত্র দেন তিনি। এবার বলুন, বেতন ও বোনাস না দিলে রাস্তায় নামা ছাড়া আর কী করার থাকে?’ তিনি আরও বলেন, ‘আশা করছি, ঝামেলা ছাড়াই বেতন ও বোনাস পাব। এবার আমরাও যানজটমুক্ত সড়ক দিয়ে গ্রামে যাব।’

চান্দনা চৌরাস্তার অটোরিকশার চালক আবুল কাশেম জানান, সব রাস্তা ভালো। তবে এই মোড়ের অবস্থা ভয়ংকর। এ অংশ সংস্কার হয়নি। খানাখন্দে ভরা। এ জন্য চারটি রাস্তায় ভয়াবহ যানজট তৈরি হতে পারে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য বলেন, গাজীপুরে যানজটের অন্যতম কারণ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। ঈদের আগে মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচল বন্ধ করতে হবে। তা ছাড়া তাকওয়া পরিবহনের অন্তত ৩০০ অবৈধ মিনিবাস চলাচল বন্ধ করলে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হতে পারে।

গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২-এর সুপার (এসপি) এ কে এম জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই, মহাসড়ক যানজটমুক্ত থাকুক। ঈদে স্বস্তি নিয়ে যাতে মানুষ বাড়ি ফিরতে পারে, সে জন্য চেষ্টা করছি। কিন্তু যানজটের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিচ্ছি না। শ্রমিকরা যদি রাস্তায় নেমে পড়ে, তাহলে তা স্বস্তির হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঈদের আগে শ্রমিকদের তিনটি দাবি। ফেব্রুয়ারির পুরো ও মার্চের অর্ধেক বেতন এবং পুরো ঈদ বোনাস। গাজীপুরে ২ হাজার ১৭৬টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। গত সাত মাসে অর্থনৈতিক সংকটে ৫০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। টিকে থাকাগুলোর মধ্যে যদি ১ শতাংশ কারখানায় ঝামেলা হয়, তবু তো ২১টিতে ঝামেলা হবে। সে ক্ষেত্রে পুরোপুরি বলা যাচ্ছে না যে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হবে।’

তিনি জানান, গতকাল পর্যন্ত ৭২ শতাংশ কারখানায় ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি রয়েছে ২৮ শতাংশ (প্রায় ৬০০) কারখানা। এর ওপর মার্চের অর্ধেক বেতন ও বোনাসের দাবি রয়েছে। মালিকরা যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের পাওনা বুঝিয়ে দেন, তাহলে ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক হতে পারে।

শিল্প পুলিশের আরেকজন কর্মকর্তা জানান, এরই মধ্যে বোনাস পুরোটা ও মার্চের অর্ধেক বেতন দিয়েছে ৩৫টি কারখানা। তাদের মতো যদি সব কারখানা শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দিয়ে দেয়, তাহলে আর কোনো ঝামেলা নেই। স্বস্তির ঈদ হতে পারে সবার জন্য।

সার্বিক বিষয়ে গাজীপুরের এসপি চৌধুরী মো. যাবের সাদেক বলেন, ঈদযাত্রা স্বস্তিদায়ক করার জন্য আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি। কোনো কারখানার শ্রমিক সড়কে নেমে আন্দোলন যাতে না করে, সেটাও নজরদারি করছি। তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের বেতন দ্রুত পরিশোধ করার জন্য অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল কারখানা মালিককে বারবার তাগাদা দেওয়া হচ্ছে। কোনোভাবে যেন শ্রমিকরা ঈদের আগে রাস্তায় না নামে, সেটা বোঝানো হচ্ছে। ২৫ রমজানের মধ্যে তাদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। জেলা পুলিশ, মহানগর পুলিশ ও শিল্প পুলিশ দফায় দফায় মালিকপক্ষের সঙ্গে কথা বলছে।

তবে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর হিসাব বলছে, গতকাল পর্যন্ত গাজীপুরের ১২৪ কারখানায় ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। বাকি দুই হাজার কারখানায় ইতোমধ্যে মজুরি পরিশোধ করা হয়েছে। জানতে চাইলে বিজিএমইএ সহায়ক কমিটির সদস্য এবং সংগঠনের সাবেক সহসভাপতি শহীদ উল্লাহ আজিম সমকালকে বলেন, ‘বাকি কারখানাগুলোও যাতে দু-এক দিনের মধ্যে মজুরি পরিশোধ করতে পারে, এ ব্যাপারে সহায়তা করছে বিজিএমইএ।’

শ্রম আইন অনুযায়ী, সমাপ্ত মাসের মজুরি পরের মাসের প্রথম ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পরিশোধ করার কথা। ১৭ তারিখেও কেন এত কারখানা মজুরি পরিশোধ করেনি– এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সব কারখানার সামর্থ্য সমান নয়। ছোট অনেক কারখানার পরিস্থিতি ভালো যাচ্ছে না। এ কারণে মজুরি পরিশোধে কিছুটা সময় লাগছে।’