গোয়েন্দা প্রতিবেদন ভুয়া তথ্য-ঘোষণায় বন্ড সুবিধার পণ্য যেভাবে চলে যায় খোলাবাজারে
নিউজ পোস্ট বিডি নিউজ পোস্ট বিডি
নিউজ পোস্ট বিডি

সেলিনা আক্তার:
একটি শার্টের জন্য এক দশমিক ৭৫ ইয়ার্ড (গজ) কাপড়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু ৩০ শতাংশ ওয়েস্টেজ দেখিয়ে আমদানি করা হয় দুই দশমিক ৭৫ ইয়ার্ড কাপড়। বন্ড-সুবিধায় আমদানি করা অতিরিক্ত এ কাপড় কৌশলে খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
একই প্রক্রিয়ায় থান কাপড়ের মতো সুতা আমদানির ক্ষেত্রেও ওয়েস্টেজ (অপচয়) বেশি দেখিয়ে বন্ড-সুবিধায় অতিরিক্ত সুতা আমদানি করা হচ্ছে। পরিবর্তন করা হচ্ছে সুতার গ্রেডও। বন্ড-সুবিধায় আসা সুতার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ চলে যায় নরসিংদী, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে। আবার আমদানিকারকেরা কাপড়ের স্যাম্পল পরিবর্তন করে দামি কাপড় আমদানি দেখিয়ে কিংবা ওজনে কারচুপি করে এলসিতে উল্লেখ করা পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত পণ্যও নিয়ে আসেন।
এ ছাড়া গার্মেন্টসের অনেক মালিক নামমাত্র ২০ থেকে ২৫টি মেশিন বসিয়ে এবং ভুয়া উৎপাদন দেখিয়ে পোশাক ব্যবসার নামে বন্ড-সুবিধার আওতায় কাপড়, সুতা ও অন্যান্য সামগ্রী আমদানি করে তা খোলাবাজারে বিক্রি করে দেন। তাদের সহযোগী হিসেবে কাস্টম কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও ভূমিকা রাখছেন। কৌশলে বন্ড-সুবিধায় আসা এসব কাঁচামাল চট্টগ্রামের টেরিবাজারে জাহাজ থেকে খালাস হয়ে সরাসরি চলে যায় ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি মার্কেটে। বন্ড লাইসেন্সধারী অসাধু প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবেই বন্ড-সুবিধায় আমদানি করা কাঁচামাল নিয়মিত খোলাবাজারে বিক্রি করছেন বলে গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।বাংলাদেশ পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) থেকে এমন একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনের পাশাপাশি বেশকিছু সুপারিশও করা হয়েছে। এনবিআরের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছে\
এ বিষয়ে কাস্টমস বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা (সদস্য) ঢাকা পোস্টকে বলেন, বন্ড-সুবিধার অপব্যবহার নতুন কিছু নয়। তবে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বেশকিছু নতুন কৌশল প্রয়োগের তথ্য উঠে এসেছে। যেখানে দেখা যায় বন্ড-সুবিধার কাপড়, সুতা ও অন্যান্য সামগ্রী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ট্রাকে করে নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় রাতের আঁধারে খালাস করা হয়। এ ছাড়া অসাধু ব্যবসায়ীরা ঢাকার কাছে চিটাগাং রোডের পাশে অবস্থিত বিভিন্ন বাড়ি অস্থায়ী গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করেন। সেখানে বন্ড-সুবিধায় আনা কাঁচামালগুলো মজুত করা হয়। পরে সুবিধা মতো সময়ে সেখান থেকে রাজধানীর ইসলামপুর, সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে চলে যায়। যার মাধ্যমে সরকারের হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব ফাঁকি দেওয়া হয়।
এনবিআর থেকে পাওয়া তথ্যানুসারে, বন্ড-সুবিধায় বিভিন্ন প্রকার ফ্যাব্রিক বা কাপড় আমদানি করা হয়। যার মধ্যে রয়েছে— নিট ফ্যাব্রিক, ওভেন ফ্যাব্রিক, ডেনিম ফ্যাব্রিক ও মেস ফ্যাব্রিক। সুতার মধ্যে রয়েছে— কটন সুতা, পলিয়েস্টার সুতা, নাইলন সুতা ও রাবার সুতা। এ ছাড়া রং হিসেবে প্রিন্টিং ইংক, সিনথেটিক অর্গানিক ডাইস, সালফার ডাইস, বেস কালার; প্যাকেজিং আইটেম হিসেবে কাগজ, ডুপ্লেক্স বোর্ড, পলি প্রোপাইলেন বা পিপি, গামটেপ, এডহেসিভ টেপ, টিস্যু পেপার, আর্ট কার্ড, কার্ড বোর্ড; টেক্সটাইল কেমিক্যাল হিসেবে অ্যামিনো সিলিকন অয়েল, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, কস্টিক সোডা, ফিনিশিং এজেন্ট, অ্যাসিটিক অ্যাসিড; লবণ আইটেম হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল সল্ট, সোডিয়াম সালফেট, রেসিস্ট সল্ট এবং বিভিন্ন প্রকার লেবেলিং আইটেম বন্ড-সুবিধায় আমদানি করা হয়।বন্ড-সুবিধায় আনা পণ্য খালাসের যত রুট
বন্ড-সুবিধার আওতায় আমদানি করা কাপড়, সুতাসহ অন্যান্য কাঁচামাল চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হতে খালাস শেষে ঢাকার আশপাশের এলাকা যেমন—নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ ও নরসিংদীতে আনা হয় এবং রাতের অন্ধকারে গাড়ি আনলোড করা হয়। এ ছাড়া ঢাকার চিটাগাং রোডের কাছাকাছি অবস্থিত অনেক বাড়ি তারা অস্থায়ী গোডাউন হিসেবে ব্যবহার করেন। এসব গোপন গোডাউন থেকে সুবিধা মতো সময়ে এসব পণ্য চলে যায় রাজধানীর ইসলামপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে। যেসব পয়েন্ট থেকে পণ্যগুলো দেশের বিভিন্ন অসাধু ব্যবসায়ীর ফ্যাক্টরিতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত ও চীন থেকে বন্ড-সুবিধায় আনা পণ্য প্রথমে চট্টগ্রামের টেরিবাজার নামক স্থানে জাহাজ থেকে আনলোড বা খালাস করা হয়। এসব পণ্য ওয়্যারহাউজে না নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রামের মার্কেটগুলোতে পাঠানো হয়। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ডের আশেপাশে আগে থেকে অনেক বাড়ি ভাড়া নিয়ে রাখা হয়। পরে ভ্যানযোগে পণ্যগুলো ঢাকায় পাঠানো হয়। বিভিন্ন কোম্পানির ওয়্যারহাউজ থেকে অবৈধ কাপড়বোঝাই ট্রাক সাধারণত রাত ১২টার পর সরাসরি ইসলামপুর ও সদরঘাটের বিভিন্ন মার্কেটে চলে যায়। মার্কেটগুলোর মধ্যে সদরঘাটের বিক্রমপুর সিটি গার্ডেন মার্কেট, ইসলামপুরের নূর ম্যানশন, সাউথ প্লাজা, গুলশান আরা সিটি, মনসুর ক্যাসেল, কে হাবিবুল্লাহ মার্কেট ও ইসলাম প্লাজা অন্যতম।
যেভাবে খোলাবাজারে যায় এসব পণ্য
গোয়েন্দাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, আমদানিকারকেরা বেশি পরিমাণ ‘ওয়েস্টেজ’ দেখিয়ে বন্ড-সুবিধার আওতায় প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাপড় আমদানি করে অন্যান্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেন। কেউ কেউ স্যাম্পল পরিবর্তন করে দামি কাপড় নিয়ে আসেন। এনবিআরের কর্মকর্তারা আমদানি করা কাপড়ের সঙ্গে স্যাম্পল যথাযথভাবে মিলিয়ে খালাস করেন না। উল্টো তাদের ম্যানেজ করে অসাধু আমদানিকারকেরা পণ্যগুলো দেশে নিয়ে আসেন, যা অর্থনীতিতে কোনো ভ্যালু অ্যাড করে না।
এ ছাড়া ওজনে কারচুপি করে এলসিতে উল্লেখ করা পরিমাণের চেয়ে অতিরিক্ত পণ্য আনা হয়। আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়ে অতিরিক্ত পণ্যের মূল্য হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে পাঠানো হয়। আবার পণ্যের প্রাপ্যতা বা ইউডি ও ইউপি সংশোধনের মাধ্যমে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত কাঁচামাল আমদানি করে রপ্তানির জন্য নির্ধারিত পোশাক তৈরির পর অবশিষ্ট কাপড় ও সুতাসহ অন্যান্য পণ্য অবৈধভাবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
সুতা আমদানির বিষয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, থান কাপড়ের মতো সুতা আমদানির ক্ষেত্রেও ওয়েস্টেজ বেশি দেখিয়ে বন্ড-সুবিধায় অতিরিক্ত সুতা আমদানি করা হয়। এ ছাড়া অসাধু আমদানিকারকেরা কার্টনে সুতা আনার ক্ষেত্রে কাস্টমসের সঙ্গে যোগসাজশ করে সুতার গ্রেড পরিবর্তন করে (৩০ কাউন্টের ঘোষণা দিয়ে ৮০ কাউন্টের সুতা) বেশি মূল্যের সুতা নিয়ে আসেন। যার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নরসিংদী, সিরাজগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন মার্কেটে বিক্রি করা হয়। আগে বৈধ পথে আনা ভ্যাট চালানের রশিদ ব্যবহার করে বন্ড-সুবিধায় আনা বিপুল পরিমাণ কাপড় খোলাবাজারে বিক্রি করে দেওয়া হয়।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের বিষয়ে যা জানা যায়
এমন অনিয়মের সঙ্গে বন্ড কমিশনারেটের কর্মকর্তারাও জড়িত বলে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। সেখানে বলা হয়েছে, কাস্টমস বন্ড কমিশনারেটের কিছু দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তার সহায়তায় অসাধু রপ্তানিকারকেরা প্রয়োজনের তুলনায় কাঁচামালের প্রাপ্যতা বেশি দেখিয়ে, এমনকি বন্ধ কারখানায় রপ্তানির অনুমোদন দেখিয়ে বন্ড লাইসেন্স নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বন্ড কমিশনারেটের নিরীক্ষা বিভাগের কিছু অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী অনৈতিক সুবিধা নিয়ে সঠিকভাবে নিরীক্ষা করেন না। ফলে বন্ড-সুবিধায় আমদানি করা গার্মেন্টস পণ্য এবং চোরাচালানের মাধ্যমে আসা পোশাকের বিক্রি বেড়েছে খোলাবাজারে।