
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
ধর্ষণ শুধু অপরাধ নয়, এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘনও বটে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক ধর্ষণের হার আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে, আছিয়ার ঘটনায় গোটা বাংলাদেশ লজ্জিত। আছিয়া মারা যায়নি, মারা গেছে আমাদের বিবেক, মারা গেছে আমাদের চোখ, মারা গেছে এ দেশে নারীদের ইজ্জতের দাম। এ সমস্যার গভীরে গিয়ে মনস্তাত্ত্বিক, সামাজিক, জৈবিক এবং আইনি দিক থেকে এর কারণ ও প্রতিরোধব্যবস্থা বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জরুরি।
ধর্ষণের কারণ ও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ :ধর্ষণের পেছনে মূলত চারটি প্রধান কারণ কাজ করে :মনস্তাত্ত্বিক প্রবণতা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, জৈবিক কারণ এবং আইনের দুর্বলতা। (১.১) মনস্তাত্ত্বিক কারণ :ধর্ষকদের মানসিক গঠনের ওপর গবেষণা করলে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায় :নারীদের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মানসিকতা—অনেক পুরুষ নারীদের নিজের সম্পত্তি বলে মনে করে, যা তাদের দমিয়ে রাখার মানসিকতা সৃষ্টি করে। সহিংস প্রবৃত্তি ও আগ্রাসন—ছোটবেলা থেকে সহিংসতা ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা থাকা অপরাধীদের মধ্যে যৌন সহিংসতার প্রবণতা বাড়ায়। সাইকোপ্যাথি ও এমপ্যাথির অভাব—কিছু অপরাধী অন্যের কষ্ট বা অনুভূতির প্রতি একেবারেই সংবেদনশীল নয়, যা তাদের নির্দয় করে তোলে। অপরাধ প্রবণতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার—সমাজে কিছু মানুষ নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে ধর্ষণের মতো অপরাধ করে, যা তাদের জন্য একধরনের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ হয়ে ওঠে। (১.২) সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণ :প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফির অপব্যবহার—সোশ্যাল মিডিয়া, ইন্টারনেট ও অশ্লীল কনটেন্টের সহজলভ্যতা অনেককে বিকৃত মানসিকতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। বিশেষ করে, সহিংস ও নারীবিদ্বেষী পর্নোগ্রাফির প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি যৌন অপরাধ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থার কিছু নেতিবাচক দিক ধর্ষণকে উত্সাহিত করছে। লিঙ্গবৈষম্য ও পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা—নারীদের দুর্বল মনে করা, তাদের স্বাধীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করার প্রচেষ্টা এবং ‘পুরুষই শ্রেষ্ঠ’ এই বিশ্বাস ধর্ষণের হার বাড়ায়। বিচারহীনতা ও আইনের দুর্বলতা অনেক ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকাররা ন্যায়বিচার পান না। ফলে অপরাধীরা উত্সাহিত হয়। ধর্ষণের পর অনেক সময় ভুক্তভোগীকে দোষারোপ করা হয়, যা অপরাধীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়।
ধর্ষণের জৈবিক ও স্নায়ুবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ :বিজ্ঞানীরা ধর্ষণের পেছনে জৈবিক কারণও বিশ্লেষণ করেছেন। টেস্টোস্টেরন ও আগ্রাসন—গবেষণায় দেখা গেছে, বেশি মাত্রার টেস্টোস্টেরন (পুরুষ হরমোন) অনেক সময় আগ্রাসী যৌন আচরণকে বাড়িয়ে দেয়। মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোভের কার্যকারিতা কমে যাওয়া—এই অংশটি আত্মনিয়ন্ত্রণ ও নৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কিছু অপরাধীর ক্ষেত্রে এটি সঠিকভাবে কাজ করে না, ফলে তারা যৌন অপরাধে লিপ্ত হয়। কিছু গবেষক মনে করেন, আদিম সমাজে জিনগত শ্রেষ্ঠত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রজননক্ষম নারীদের ওপর জোর করে দখল প্রতিষ্ঠা করা হতো, যদিও এটি আজকের সভ্য সমাজে একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কিছু অপরাধীর জেনেটিক পার্থক্য তাদের আচরণকে সহিংস করে তুলতে পারে।
ধর্ষণের প্রভাব ও পরিণতি :ধর্ষণের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী এবং গভীর হয়। যৌনাঙ্গে গুরুতর আঘাত ও অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ ঘটে। যৌনরোগের সংক্রমণ (এইচআইভি, এইচপিভি, অন্যান্য সংক্রমণ), অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ এবং গর্ভপাতের ঝুঁকি। ধর্ষণের শিকাররা দীর্ঘ মেয়াদে মানসিক আঘাত বহন করেন। বাংলাদেশে ধর্ষণের শিকার নারীদের মধ্যে আত্মহত্যার হার বেশি। সামাজিক বিচ্ছিন্নতা ও আত্মবিশ্বাসের অভাব—অনেক ভুক্তভোগী সমাজের ভীতি ও কুসংস্কারের কারণে চুপ করে থাকেন এবং একাকিত্বে ভোগেন।
বাংলাদেশে ধর্ষণ প্রতিরোধে বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। প্রমাণ সংগ্রহের প্রক্রিয়া সহজ করে ফরেনসিক সাপোর্ট নিশ্চিত করতে হবে। সামাজিক আন্দোলন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ এবং প্রযুক্তি ও পর্নোগ্রাফির অপব্যবহার প্রতিরোধ চালু করতে হবে। অপরাধীদের মানসিক চিকিত্সা ও পুনর্বাসন প্রয়োজন। যৌন অপরাধপ্রবণ ব্যক্তিদের জন্য মানসিক চিকিত্সা ও কাউন্সেলিং চালু করা উচিত। ধর্ষণের পেছনের মানসিক সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে মনস্তাত্ত্বিক থেরাপি চালু করতে হবে। এগুলো বাস্তবায়ন করা গেলে সমাজে ধর্ষণের হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে পারে।
ধর্ষণ একটি জটিল সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা, যার সমাধান কেবল আইন দিয়ে সম্ভব নয়। এটি প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা, ধর্মীয় শিক্ষা, বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা এবং নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সংস্কৃতি গড়ে তোলা। গবেষণা ও বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, ধর্ষণের বিরুদ্ধে লড়াই কেবল আইনি নয়, বরং এটি সমাজের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের লড়াইও।
লেখক : ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (ডেইরি অ্যান্ড পোলট্রি সায়েন্স) এবং পরিচালক, পোলট্রি রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম