
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
স্বামী বিবেকানন্দের অসংখ্য পরিচয়ের মধ্যে একটি হলো—তিনি ভূপর্যটক। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, রাওয়ালপিন্ডি থেকে আসামরাজ্য তিনি হেঁটে বেড়িয়েছেন। দুবার আমেরিকা গেছেন, চীন ও জাপান গেছেন, ইউরোপেরও বহু দেশ ঘুরেছেন। রামমোহন-দ্বারকানাথ-রবীন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্র সেন-শিবনাথ শাস্ত্রীরাও গিয়েছেন। তবে তারা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের। সনাতনপন্থিদের ধর্মীয় যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, সেই বিধানকে যে তিনি মানেননি, এটাও তার একটা সংস্কারমুক্তির অংশ।
আশ্চর্যের কথা, সেই বিবেকানন্দের কিন্তু দীর্ঘদিন পূর্ববঙ্গ বা ঢাকায় আসা হয়নি, যদিও একাধিক লোকের কাছে তিনি ঢাকায় আসার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য সাধু নাগমহাশয়ের কাছেও তিনি প্রতিশ্রুত ছিলেন, তার জন্মভূমি ঢাকায় তিনি যাবেন। গেলেন যখন, তখন নাগ মহাশয় আর জীবিত নেই।
ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বাঙালি তথা সমগ্র উপমহাদেশের কাছেই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি ঐতিহ্যর জন্য খ্যাত। বাঙালি মনীষীদের কেউ-ই তাই ঢাকায় আসননি, এমনটা হয়নি, তা সে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল-শরত্চন্দ্র-ই হোন, বা গান্ধী-সুভাষচন্দ্র।
স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকায় আগমন ও দুই সপ্তাহের মতো এখানে অবস্থান নিয়ে নানান জনের নানান লেখা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে মন্মথ গাঙ্গুলীর স্মৃতিকথা, আইনজীবী সতীশচন্দ্র রায়ের লেখা, বিপ্লবী বীর ও পরবর্তীকালে ‘অনুশীলন সমিতি’র হোতা হেমচন্দ্র ঘোষের বর্ণনা, তত্কালীন ‘ঢাকাপ্রকাশ’ পত্রিকায় স্বামীজি-সংক্রান্ত খবরাখবর। তাছাড়া স্বামীজির ‘ধীরা মাতা সারা চ্যাপম্যান থর্প বুলের স্বামী নরওয়েজীয় বিশ্বখ্যাত পিয়ানোবাদক ওলি বুলকে লেখা চিঠিতে। মেরি হলকে লেখা তার চিঠিতে আছে পূর্ববঙ্গ দর্শন নিয়ে উচ্ছ্বাস। পরবর্তীকালে রামকৃষ্ণ মিশনের বর্তমান মঠাধ্যক্ষ স্বামী সম্পূর্ণানন্দজি হেমচন্দ্র ঘোষের সুদীর্ঘ সাক্ষাত্কার নিয়েছিলেন, যেখানে স্বামীজির ঢাকায় অবস্থানের দিনগুলির কথা বিশদভাবে উঠে এসেছে।
স্বামীজি ১৯০১-এর ১৮-ই মার্চ তারিখে বেলুড় মঠ থেকে ন’জন রামকৃষ্ণভক্তসহ ট্রেনে ওঠেন। পরদিন সকালে গোয়ালন্দ পৌঁছে স্টিমারযোগে নারায়ণগঞ্জে যান। সেখান থেকে ট্রেনে ঢাকায় আসেন। এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য কিন্তু মাকে ঢাকেশ্বরী তীর্থ দর্শন করানো। অতএব মা-ও এসেছিলেন। আর আসেন স্বামীজির বোন ও মায়ের কয়েক জন সখী।
স্বামীজি তখন সারা দেশেই জননন্দিত এক তেজস্বী পুরুষ। তাই তার ঢাকায় আগমন জনমানসে সাড়া ফেলে দিল। তিনি ঢাকার বিখ্যাত জমিদার মোহিনীমোহন দাসের ফরাসগঞ্জের বাড়িতে সতেরো দিন ছিলেন।
গোয়ালন্দ থেকে পদ্মা দেখতে দেখতে আসা তার। মন্মথ গাঙ্গুলীর স্মৃতিকথায় পাই, এক টাকা দিয়ে ষোলোটি ইলিশ মাছ কেনা হলো সেখানে। স্টিমার থামিয়ে নিকটস্থ গ্রাম থেকে জোগাড় করা হলো চাল আর পুঁইশাক। স্বামী নিত্যানন্দ ও অন্য ভক্তরা তো ছিলেনই, মাঝিমাল্লা ও খালাসিসহ সবাইকে নিয়ে আহার করলেন তিনি।
স্বামীজিকে দেখতে, তার সঙ্গ পেতে প্রতিদিনই বহু মানুষ আসতেন জমিদারবাড়িতে। তাদের মধ্যে হেমচন্দ্র ঘোষ ও দেবেন্দ্রনাথ রায় অন্যতম। দেবেন্দ্রনাথের অনুরোধে স্বামীজি তাকে গান গেয়েও শুনিয়েছিলেন।
ঢাকায় এসে খুব বেশি বক্তৃতা দেননি তিনি। সম্ভবত তার শারীরিক অসুস্থতাই তার কারণ। মার্চের তিরিশ তারিখে রমাকান্ত নন্দীর সভাপতিত্বে ঢাকার বিখ্যাত জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়) ভাষণ দেন। বিষয় ‘আমি কী দেখেছি’। শ্রোতার সংখ্যা ছিল ২ হাজার। পর দিন অর্থাত্ ৩১.০৩-এ বক্তৃতা দেন পোগোজ স্কুলে, ৩ হাজার দর্শকের সামনে। বক্তৃতার বিষয় ছিল ‘আমাদের জন্মপ্রাপ্ত ধর্ম’।
এর আগেই তিনি মাকে নিয়ে যান লাঙ্গলবন্দ। ঢাকার অদূরে ব্রহ্মপুত্রের পারে এটি হিন্দুদের একটি তীর্থক্ষেত্র। কথিত আছে, মাতৃহত্যাজনিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে দশ অবতারের অন্যতম পরশুরাম এখানে স্নান করে শুদ্ধ ও পাপমুক্ত হন। সাতাশে মার্চ স্বামীজি এখানে ‘বুধাষ্টমী’ তিথিতে ব্রহ্মপুত্রে অবগাহন করেন।
স্বামীজির ঢাকা আসার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঢাকায় অদূরে দেবভোগ গ্রামে সাধু নাগমহাশয়ের গৃহে যাওয়া। শ্রীরামকৃষ্ণের গৃহী শিষ্য ছিলেন দুর্গাচরণ নাগ। আসার সময় নাগ-মহিষী তাকে যে কাপড় উপহার দিয়েছিলেন, পাগড়ি করে তা পরেন স্বামীজি।
স্বামীজি ঢাকার মানুষজনকে যে তীক্ষভাবে অবলোকন করেছিলেন, তার প্রমাণ পাই ‘স্বামিশিষ্যসংবাদ’-এ বর্ণিত লেখা থেকে। লেখক শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর দেশ পূর্ববঙ্গ বলে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, ঢাকার মানুষদের ঠিক কেমন দেখলেন স্বামীজি? স্বামীজির উত্তর, ‘আমাদের এদিকের চেয়ে লোকগুলো কিছু মজবুত ও কর্মঠ। তার কারণ বোধহয় মাছ-মাংসটা খুব খায়।’ রান্নাবান্নায় অতিরিক্ত তেল দেওয়া ও তার ক্ষতি নিয়েও বলেছেন তিনি,‘খাওয়াদাওয়াতে খুব তেল চর্বি দেয়, ওটা ভালো নয়। তেল চর্বি বেশি খেলে শরীরে মেদ জন্মায়’।
স্বামীজি ঢাকায় পৌঁছতে তাকে সংবর্ধনা দেন আইনজীবী ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ও গণেশচন্দ্র ঘোষ। আর নারায়ণগঞ্জে তাকে সংবর্ধনা দেয় ‘ঢাকা অভ্যর্থনা সমিতি’।
পূর্ববঙ্গের নদীর বিশালতা ও মাধুর্য স্বভাবতই ঢাকা ঘুরে আসার বেশ কিছুদিন পর্যন্ত যে তার মনে গেঁথে ছিল এবং তাকে মুগ্ধ না করে পারেনি। তার প্রমাণ পাই এই ভ্রমণের তিন মাস বাদে ৫.৭.১৯০১-এ শ্রীমতী মেরি হলকে লেখা তার একটি চিঠিতে, ‘তুমি জানো, আমার এই দেশকে বলা হয় জলের দেশ। কিন্তু তার তাত্পর্য পূর্বে কখনো এমনভাবে উপলব্ধি করিনি। পূর্ব বাংলার নদীগুলি যেন তরঙ্গসংকুল স্বচ্ছ জলের সমুদ্র, নদী মোটেই নয় এবং সেগুলি এত দীর্ঘ যে স্টিমার সপ্তাহের পর সপ্তাহ এদের মধ্যে দিয়ে চলতে থাকে।’ প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ১৯৯৮ ও ১৯২৬, এই দুবার ঢাকা আসেন। প্রথম বার বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলনে। নজরুল আসেন ‘সৃষ্টিসুখের উল্লাসে’। জীবনানন্দ নিজ বিবাহোপলক্ষ্যে। ঢাকার ব্রাহ্ম মন্দিরে বিয়ে হয় তার।
স্বামীজির ঢাকা ভ্রমণের সারাত্সার সম্ভবত এই, তিনি এখানে এসে উপলব্ধি করেছিলেন, পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে আরো দৃঢ় ভ্রাতৃত্ববন্ধন আবশ্যক।
তার ঢাকায় পদার্পণের ১২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। তার আগে ২০২৩-এ ৭৪, বি কে দাস রোডের যে বাড়িতে স্বামীজি থেকেছেন, সেখানে তার স্মৃতিচিহ্নিত একটি ফলক উন্মোচিত হয়েছে। সে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথিরূপে যোগ দিয়ে স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজি বলেন, ‘ঢাকা কেন্দ্র’-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আছে, যারা স্বামী বিবেকানন্দের বসতধন্য একটি বাড়িকে পরিচয় করানোর ব্রত নিয়েছেন। এটি আমাদের কাছে আনন্দের ও গর্বের।’ ঢাকা কেন্দ্র পরিচালক ও সে-অনুষ্ঠানের সভাপতি মোহাম্মদ আজিম বখশ বলেন, ‘স্বামী বিবেকানন্দের ঢাকায় আগমন ঢাকার ইতিহাসকে মহিমান্বিত ও সমৃদ্ধ করেছে। ঢাকার ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ যেসব ইতিহাস কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছিল, তা পুনরুজ্জীবিত করতে ঢাকা কেন্দ্র সচেষ্ট থাকবে’।
ঢাকা পর্ব শেষ করে স্বামীজি ১.৪.১৯০১-এ ট্রেনযোগে চট্টগ্রাম যাত্রা করেন। উদ্দেশ্য, মা ভুবনেশ্বরীকে সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ তীর্থ দর্শন করানো। ২৯.৩-এ ওলি বুলকে স্বামীজির লেখা চিঠি থেকে এ তথ্য জানা যায়। সীতাকুণ্ডে উপস্থিত হয়ে তিনি অতিথি হন জমিদার রায়বাহাদুর হরকিশোর রায়চৌধুরীর গৃহে।