
ডেস্ক রিপোর্ট:
কাশ্মীরের দক্ষিণে অনন্তনাগ জেলার পহেলগামের বৈসারণ উপত্যকায় এক ভয়ংকর দিনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, যখন একাধিক বন্দুকধারী পর্যটকদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। তখন সেই গোলাগুলির মাঝে দাঁড়িয়ে, নিজের জীবনের তোয়াক্কা না করে, কয়েকজন অমুসলিম পর্যটকের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন এক সাহসী মুসলিম যুবক—সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ।
মাত্র ২৮ বছর বয়সী আদিল ছিলেন স্থানীয় একজন ঘোড়ার চালক। বৈসারণ উপত্যকায় পর্যটকদের ঘোড়ায় করে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করাতে করাতেই চলত তার জীবিকা। সেই দিনে তিনি এক পর্যটক পরিবারকে উপত্যকার সৌন্দর্য ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই ভেসে আসে গুলির শব্দ। হামলাকারী সন্ত্রাসীরা পর্যটকদের ধর্ম জানতে চায় এবং তারপর বেছে বেছে গুলি চালাতে শুরু করে।
এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে অন্যরা যখন প্রাণ বাঁচাতে দৌড়ে পালাচ্ছিলেন, তখন আদিল থেমে যাননি। বরং সাহসিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তিনি এক বন্দুকধারীর দিকে দৌড়ে যান এবং তার অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। এই কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনেক পর্যটক পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান। তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হন এবং সন্ত্রাসীরা আদিলকে গুলি করে হত্যা করে।
এই সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন পর্যটকসহ মোট ২৬ জন, যা সাম্প্রতিক সময়ের কাশ্মীর অঞ্চলের অন্যতম মর্মান্তিক ঘটনা। তবে আদিলের আত্মত্যাগ যেন এক আলোর রেখা, যা কাশ্মীরের মানুষকে নতুন করে মানবতার পাঠ পড়িয়েছে। তিনি শুধু সাহসিকতার পরিচয় দেননি, বরং প্রমাণ করেছেন, সন্ত্রাস ও ঘৃণার বিরুদ্ধে ভালোবাসা ও সহানুভূতি আজও বেঁচে আছে।
আদিলের এক সহকর্মী গুলাম নবি বলেন, সে এক মুহূর্তও ভাবেনি। সে দেখল গুলি পর্যটকদের দিকে তাক করা, আর সঙ্গে সঙ্গেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। জীবন দিল, কিন্তু অপরিচিত কিছু মানুষকে বাঁচিয়ে দিল।
আদিলের মৃত্যুতে তার পরিবার শোকে ভেঙে পড়েছে। তার মা দরজায় বসে অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, সে ছিল আমাদের প্রাণ। ঘরের সব খরচ চালাতো, আমাদের দেখভাল করতো। সম্মানের সঙ্গে বেঁচে ছিল। এখন ও নেই, আমরা দিশেহারা। কিন্তু ও যেটা করেছে, তার জন্য আমি গর্বিত।
তার মা আরও বলেন, সে আমাদের একমাত্র ভরসা ছিল। ঘোড়া চালিয়ে যা আয় করত, তাই দিয়ে সংসার চলতো। এখন আমাদের দেখার মতো কেউ আর নেই। আমরা জানি না কীভাবে বাঁচবো।
স্থানীয় দোকানদার ইমতিয়াজ লোন বলেন, সে কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মারা যায়নি। সে মারা গেছে এমন একটি উদ্দেশ্যে, যা মানুষের হৃদয়ে লেখা থাকে। যখন সন্ত্রাসীরা আমাদের ধর্মের নামে ভাগ করতে চেয়েছিল, তখন একজন মুসলিম নিজের জীবন দিয়ে অমুসলিমদের রক্ষা করেছিল। এটাই কাশ্মীর, এটাই আমাদের সত্যিকারের পরিচয়।
তিনি আরও বলেন, যখন সন্ত্রাসীরা বিভাজনের বুলেট নিয়ে এসেছিল, তখন আদিল ভালোবাসা নিয়ে সামনে দাঁড়িয়েছিল। সে শুধু জীবন বাঁচায়নি, আমাদের বিবেকও রক্ষা করেছে।
এই করুণ ঘটনার মধ্যেও আদিল একটি চিরন্তন সত্য মনে করিয়ে দিলেন—মানবতা ঘৃণার চেয়ে শক্তিশালী, আর ভালোবাসা বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র।
সৈয়দ আদিল হুসেন শাহ এখন শুধুই একজন শহীদ নন—তিনি কাশ্মীরি সাহসিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা ও মানবতার এক অনন্য প্রতীক।