ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে ঋণ শোধ করেননি অনেক ব্যবসায়ী। ফলে ঋণখেলাপিদের কাছে আটকে আছে ব্যাংকগুলোর বড় অঙ্কের টাকা। যার পরিমাণ ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকা। আর এসব খেলাপি গ্রাহক বিভিন্ন সময়ে পরিশোধ করেছেন ২৬ হাজার ৮৩৬ কোটি টাকা। শীর্ষ খেলাপির তালিকায় রয়েছে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, বিল্ডট্রেড, হলমার্কসহ আলোচিত ঋণ কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িতরা। আবার কিছু ভালো ব্যবসায়ীর নামও খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের পক্ষে বুধবার জাতীয় সংসদের টেবিলে এ তালিকা উপস্থাপন করা হয়। অর্থমন্ত্রীর কাছে সংসদ সদস্য আহসানুল ইসলাম জানতে চেয়েছিলেন, যেসব কোম্পানি ঋণখেলাপি, তাদের খেলাপি ঋণ ও পরিশোধিত ঋণের পরিমাণ কত?
এর জবাবে অর্থমন্ত্রী জানান, গত নভেম্বর পর্যন্ত যেসব কোম্পানি ঋণখেলাপি, তাদের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৯৬ হাজার ৯৮৬ কোটি টাকা। তারা ২৬ হাজার ৮৩৬ কোটি পরিশোধ করেছে। সংসদে অর্থমন্ত্রী ৮ হাজার ২৩৮ প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ও তাদের পরিশোধিত ঋণের তালিকা তুলে ধরেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি ডেটাবেইস থেকে ২০১৯ সালের নভেম্বরভিত্তিক এ তালিকা দেওয়া হয়।
এ ছাড়া অর্থমন্ত্রী এক প্রশ্নের জবাবে সংসদে জানান, ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বিতরণ করা ঋণ ছিল ৩১ হাজার ২৮ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ছিল ৯ হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। ২০০৮ সাল শেষে ঋণ বেড়ে হয় ২ লাখ ৮ হাজার ৩৬২ কোটি টাকা, এর মধ্যে খেলাপি ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরে ঋণ বেড়ে হয় ৯ লাখ ৬৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণ বেড়ে হয় ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। ফলে ২০০৮ সালের তুলনায় খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৫ গুণের বেশি।
সংসদে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া তালিকা অনুযায়ী, দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপি গ্রাহক এখন অ্যাননটেক্স, এরপরই ক্রিসেন্ট গ্রুপ। এ প্রতিষ্ঠান দুটি রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠান দুটিই ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করেছে, আবার ব্যাংকের ঋণও শোধ করেনি। অ্যাননটেক্সের মালিক ইউনুছ বাদল বর্তমানে দেশে নেই, আর ক্রিসেন্টের মালিক এম এ কাদের কারাগারে। তবে ক্রিসেন্টের আরেক মালিক চলচ্চিত্র প্রযোজক আবদুল আজিজ রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
এ ছাড়া খেলাপির শীর্ষ তালিকায় আরও রয়েছে বিল্ডট্রেড গ্রুপ ও চ্যানেল নাইনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুর রহমান। তাঁর কাছে ব্যাংকগুলোর পাওনা প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা। স্বাস্থ্য খাতের আলোচিত ব্যবসায়ী মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর ঢাকা সেন্ট্রাল ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ, নর্থ বেঙ্গল পোলট্রিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এ দুই গ্রাহকই নামে বেনামে বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংক থেকে প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বের করে নিয়েছেন।
খেলাপির তালিকায় ভালো কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নামও উঠেছে। এর মধ্যে রয়েছে রহিম আফরোজ, নাভানা লিমিটেড, অটবি, আবদুল মোনেম সুগার রিফাইনারি, কেয়া, গ্রামীণ শক্তি, সিনহা ইয়ার্ন অ্যান্ড ডায়িং, এনা প্রোপার্টিজসহ আরও কয়েকটি।
খেলাপির তালিকায় আরও রয়েছে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক, রূপালী ব্যাংকের বেনিটেক্স ও গোল্ড আনোয়ার, অগ্রণী ব্যাংকের গ্রাহক জাহাজ ভাঙা ও নির্মাণ খাতের কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। আবার এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা কয়েকজন গ্রাহকও এখন শীর্ষ খেলাপির তালিকায় উঠে এসেছে। গণমাধ্যমের মালিকদের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও এ তালিকায় নাম লিখিয়েছে। তার মধ্যে মোহাম্মদ আতিকউল্লাহ খান মাসুদের খেলাপি প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ব্যবসায়ী এম এন এইচ বুলুর খেলাপি ঋণ ২৫০ কোটি টাকা।
বিকল্পধারার মহাসচিব মেজর (অব.) আবদুল মান্নানের বাংলালায়নের খেলাপির পরিমাণ ৫১৮ কোটি টাকা। ব্যবসায়ী সাইদ হোসেন চৌধুরীর পরিবারের এইচআরসি শিপিংয়ের ১৭০ কোটি টাকা। খেলাপির তালিকায় আরও রয়েছে বিএনপিপন্থী ব্যবসায়ীদের মধ্যে মুন্নু গ্রুপ, ঢাকা ডায়িং, দুসাই হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট।
ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানও ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খেলাপি হয়ে গেছে। এ তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, পিপলস লিজিংসহ আরও কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অ্যাপোলো ইস্পাত, এমারেল্ড ওয়েল্ডও খেলাপি।
আবাসন খাতের প্রতিষ্ঠান অ্যাডভান্সড ডেভেলপমেন্ট টেকনোলজি ও কক্স ডেভেলপার্সও খেলাপি। বেসরকারি বিমান কোম্পানি ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান করোলা করপোরেশন, পারটেক্স সুগার মিলসও খেলাপি হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, মহাজোট সরকার দায়িত্ব নেওয়ার সময় ২০০৯ সালের শুরুতে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। বর্তমানের খেলাপি ঋণের সঙ্গে অবলোপন ঋণ যুক্ত করলে খেলাপি ঋণ দাঁড়ায় দেড় লাখ কোটি টাকা।
গত বছরে ঋণখেলাপিদের বড় সুবিধা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। খেলাপিদের বকেয়া ঋণের ২ শতাংশ টাকা জমা দিয়েই ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেওয়া হয়। এতে সুদহার ধরা হয় সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ। আর ঋণ পরিশোধে এক বছরের বিরতিসহ ১০ বছরের মধ্যে বাকি টাকা শোধের বিধান করা হয়। এ সুবিধার আওতায় আগামী ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ রয়েছে।