নিজস্ব প্রতিবেদক:
তিতাস কোম্পানির অনিয়ম-দুর্নীতি রোধে, গ্রাহক সেবার মান বৃদ্ধিসহ সরকারের রাজস্ব বাড়াতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে গিয়ে দুষ্টচক্রের কবলে পড়েছেন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। অভিযোগ উঠেছে, সংস্থাটির ব্যাপক-অনিয়ম-দুর্নীতি ঠেকাতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে কঠোর দিক-নির্দেশনা দেওয়ায় চক্রটি তার নিয়োগ ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে। তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলছেন, তিতাসের উন্নয়ন-সম্প্রসারণ এবং গ্রাহক সেবার মানবৃদ্ধিসহ সরকারের রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে এমডি হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ শক্ত অবস্থান নেওয়ায় স্বার্থান্বেষী একটি মহল তার বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য ও অভিযোগ দিয়ে গুজব রটাচ্ছে। রোববার (১ অক্টোবর) তিতাস কর্তৃপক্ষসহ গ্রাহক ও মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, সংস্থাটিতে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল ব্যাপক অনিয়ম। বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করেই কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী ও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের ইচ্ছেমত তিতাস গ্যাস বিক্রয়-বিতরণ, বিপণন ও গ্যাস সরবরাহ থেকে শুরু করে সংযোগ পর্যন্ত নানা অপকর্ম, ঘুষ বাণিজ্য ও লুটপাটের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। এতেই সংস্থাটিতে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের দুষ্টচক্রের বিরাগভাজন হয়ে পড়েন নীতিনিষ্ঠ এই কর্মকর্তা। ফলে সরকার যখন তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব দেয়ার কথা ভাবছেন, তখনই তার বিরুদ্ধে নামে-বেনামে অভিযোগ তোলার পাঁয়তারা চালাচ্ছে চক্রটি। তবে সম্প্রতি তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গুজব রটানো ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের লোকজনকে জড়িয়ে মিথ্যা তথ্য সরবরাহকারীদের বিষয়ে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ এমডি পদে দায়িত্ব নেয়ার ২১ মাসের মধ্যেই ৬ লাখ ৬৯ হাজার ৪৮৬টি গ্যাসের চুলা, ৫১৫টি শিল্প, ৫২৯টি বাণিজ্য, ১৭৯টি ক্যাপটিভ ও ৫৪টি সিএনজি গ্রাহকের অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন এবং ৭৪৪ দশমিক ৪১ কিলোমিটার অবৈধ পাইপলাইন অপসারণ করেন। এছাড়া বিভিন্ন অনিয়ম ও অবৈধ কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দুই মেয়াদে তিনি ৫ জনকে বরখাস্ত, ১৪ জনকে সাময়িক বরখাস্তসহ মোট ১৮৯ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেন। ওই ২১ মাসের মেয়াদে ১ হাজার ৫০ জনকে বিভিন্ন শাখায় বদলিও করেন তিনি। এছাড়া ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে মোট ৪০৪ দশমিক শূন্য ৬ কোটি টাকা আদায় করা হয়।
তিতাস কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে কোম্পানির অর্জিত কর পূর্ববর্তী ও কর পরবর্তী মুনাফার পরিমাণ যথাক্রমে ৩৮৬.৮৬ কোটি টাকা ও ৩১৮.০২ কোটি টাকা, যার পরিমাণ গত বছরে ছিল ৪৩৩.১৫ কোটি টাকা ও ৩৪৫.৯৮ কোটি টাকা। আলোচ্য বছরে শেয়ার প্রতি আয় ৩.২১ টাকা, যা গত বছরে ছিল ৩.৫০ টাকা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাস গ্যাসের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ব্যবস্থাপনা পরিচালকের এসব কঠোর সিদ্ধান্তে নাখোশ হন তিতাসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ বেশকিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অবৈধ সংযোগদানে জড়িত থাকা এবং মাঠপর্যায়ের গ্রাহকদের সতর্কতা না করে অর্থের বিনিময়ে বিচ্ছিন্ন সংযোগ চালু করে অফিসে ফিরে আসা কর্মকর্তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেন নীতির প্রতি আপোষহীন তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্। একই সঙ্গে তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর নানান অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগে এপর্যন্ত ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেন। এতে ওই দুষ্টচক্রটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। চক্রের সদস্যরা এরপরই তার বিরুদ্ধে অপতৎপরতা শুরু করেন। তারা নামে-বেনামে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নাম ব্যবহার করে নানা ধরনের অভিযোগ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠান। সেগুলো বিভিন্ন সাংবাদিকের কাছে সরবরাহ করে ভিত্তিহীন ও অসত্য খবর প্রকাশের মাধ্যমে তার তৃতীয় দফার নিয়োগ বাতিল করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন।
এদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীন তিতাস গ্যাসের একটি সংযোগকে ঘিরে সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ একটি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে।
ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করে উৎকোচ গ্রহণের অভিযোগের পাশাপাশি একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে তিতাস গ্যাসের সংযোগ প্রদানসহ নানাবিধ অনিয়ম’ খবরের বিপরীতে তিতাস গ্যাস টিঅ্যান্ডডি কো. লি.-এর বক্তব্য হচ্ছে- যেকোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাস সংযোগ প্রদানের ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সংযোগ প্রদান করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর নাম ব্যবহার করার সংবাদটি মিথ্যা, বানোয়াট ও ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রচার।
তিতাসের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তারা জানান, ভিত্তিহীন অভিযোগগুলো তদন্তাধীন। তার পরও কুচক্রীমহল বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়াচ্ছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি তদন্তাধীন বিষয় নিয়ে বিভ্রান্তিকর সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে তিতাসের পক্ষ থেকে।
উল্লেখ্য, আব্দুল লতিফ নামে এক ব্যক্তির মিথ্যা অভিযোগ সামনে এনে চক্রটি তার তৃতীয় মেয়াদের নিয়োগ ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী আব্দুল লতিফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে তিতাসের এমডি মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ্ বলেন, অবৈধ গ্যাস সংযোগের বিরুদ্ধে তিতাস গ্যাস কর্তৃক পরিচালিত অভিযানে যাদের স্বার্থহানি হয়েছে, তারাই উদ্দেশ্যমূলকভাবে নানা কল্পিত অভিযোগ ও অপপ্রচার চালাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে আমাকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালিয়ে তিতাস গ্যাস নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সরকারের সাফল্য মøান করার অপচেষ্টায় রয়েছে সরকারবিরোধী সিন্ডিকেট। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য মিথ্যা তথ্য দিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে সামাজিকভাবে হেয় করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
তিতাসের এমডি বলেন, ‘আমার কর্মময় জীবনে আমি নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। তাই তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি আগের তুলনায় অন্ধকার থেকে আলোর মুখে ফিরে আসছে। গ্রাহক সেবার মানবৃদ্ধিসহ সরকারের রাজস্ব বাড়ানো হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গ্যাসের বিষয়ে যেখানেই অনিয়ম-দুর্নীতির খবর পেয়েছি, সেখানেই অভিযান চালিয়েছি। কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা আদায় ও সংযোগ বিচ্ছিন্নকরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে এসব ঘটনায় সংস্থাটিতে কর্মরত কারো নাম উঠে আসলে তা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেছি। এতেই তারা আমার ওপর বিরাগভাজনে পরিণত হয়ে মিথ্যে তথ্য দিয়ে সরকারের উপর মহলের নাম ব্যবহার করে আমাকে জড়িয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে, গুজব রটাচ্ছে। যেহেতু বিষয়টি সরকারের উচ্চ পর্যায়ে তদন্তাধীন, তাই ইতোমধ্যেই গুজব ছড়ানো ও অপপ্রচারকারীদের চিহ্নিত করতে সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছি।