ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ও উত্তর সিটি করপোরেশনে (ডিএনসিসি) আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ফজলে নূর তাপস এবং একই দলের অপর প্রার্থী মো. আতিকুল ইসলামকে বেসরকারিভাবে বিজয়ী ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন। শনিবার (১ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা দক্ষিণের রিটার্নিং কর্মকর্তা আব্দুল বাতেন শিল্পকলা একাডেমি থেকে এবং রাত আড়াইটার পর ঢাকা উত্তরের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আবুল কাসেম শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় অডিটরিয়াম থেকে পৃথকভাবে এ ফলাফল ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই নগরপিতা হওয়ার ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখলো আওয়ামী লীগ।
ঘোষিত ফলাফল অনুযায়ী ঢাকা দক্ষিণের মোট ১,১৫০টি কেন্দ্রের মধ্যে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী শেখ ফজলে নূর তাপস নৌকা প্রতীকে ৪ লাখ ২৪ হাজার ৫৯৫ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির মনোনীত প্রার্থী ইশরাক হোসেন ধানের শীষ প্রতীকে পেয়েছেন ২ লাখ ৩৬ হাজার ৫১২ ভোট। এছাড়া ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী আবদুর রহমান হাতপাখা প্রতীকে পেয়েছেন ২৬ হাজার ৫২৫ ভোট। গণফ্রন্টের প্রার্থী আবদুস সামাদ সুজন মাছ প্রতীকে পেয়েছেন ১২ হাজার ৬৮৭ ভোট।
অন্যদিকে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির প্রার্থী সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন লাঙল প্রতীকে পেয়েছেন মাত্র পাঁচ হাজার ৫৯৩ ভোট। এছাড়া বাংলাদেশ কংগ্রেসের মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে আয়াতুল্লাহ ডাব প্রতীকে দুই হাজার ৪২১ এবং ন্যাশনাল পিপলস পার্টির মো. বাহারানে সুলতান বাহার আম প্রতীকে তিন হাজার ১৫৫টি ভোট পেয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মোট ভোটার ২৪ লাখ ৫৩ হাজার ১৯৪জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪৪১ এবং নারী ভোটার ছিলেন ১১ লাখ ৫৯ হাজার ৭৫৩ জন। ওয়ার্ড সংখ্যা ৭৫, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ২৫টি। তবে দক্ষিণে ভোটের হার ছিল খুবই কম। মাত্র ২৯.০০২ শতাংশ ভোট কাস্টিং হয় বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
অন্যদিকে ঢাকা উত্তরে নৌকা প্রতীক নিয়ে মো. আতিকুল ইসলাম পেয়েছেন ৪ লাখ ৪৭ হাজার ২১১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়াল পেয়েছেন ২ লাখ ৬৪ হাজার ১৬১ ভোট। এছাড়াও হাতপাখা প্রতীকে ইসলামী আন্দোলনের শেখ ফজলে বারী মাসউদ পেয়েছেন ২৮ হাজার ২০০ ভোট, কাস্তে প্রতীকে কমিউনিস্ট প্রার্থী আহম্মেদ সাজেদুল হক রুবেল পেয়েছেন ১৫ হাজার ১২২ ভোট, আম প্রতীকে আনিসুর রহমান দেওয়ান পেয়েছেন ৩ হাজার ৮৫৩ ভোট এবং বাঘ প্রতীকে শাহীন খান পেয়েছেন ২ হাজার ১১১ ভোট।
উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোট প্রদানের হার দক্ষিণের থেকেও কম। মাত্র ২৫.৩০ শতাংশ ভোট কাস্ট হওয়ার তথ্য জানিয়েছে কমিশন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মোট ভোটার ছিল ৩০ লাখ ১২ হাজার ৫০৯ জন। ওয়ার্ড সংখ্যা ৫৪, সংরক্ষিত ওয়ার্ড ১৮।
এরআগে, দিনের বেলায় ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার বিষয়ে সাংবাদিকরা জানতে চাইলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা বলেছিলেন, ‘যারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন, ভোটার আনার বিষয়ে তাদের দায়িত্ব বেশি। এক্ষেত্রে আমাদের দায়িত্ব কম। আমাদের পরিপূর্ণ দায়িত্ব আমরা পালন করেছি।’
এদিকে ভোটগ্রহণে অনিয়ম, দলীয় এজেন্টদের মারধর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানো এবং ফল ঘোষণায় অনিয়মের অভিযোগ এনে দুই সিটির নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে রবিবার (২ ফেব্রুয়ারি) ঢাকায় হরতাল ডেকেছে বিএনপি। তবে এ হরতাল প্রতিহতের ঘোষণা তাৎক্ষণিকভাবে আসে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে।
নির্বাচনের ফলাফল শুরু থেকেই পক্ষে আসায় আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীদের কার্যালয়গুলোতে সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় উৎসবের আমেজ। রাত সাড়ে সাতটার দিকেই প্রতিটি কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগের এজেন্টদের পাঠানো খবরে জয় নিশ্চিত জেনে বনানীতে স্থাপিত কার্যালয়ে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আতিকুল ইসলাম। তিনি মন্তব্য করেন, শপথ নেওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বী তাবিথ আউয়ালকে তিনি আমন্ত্রণ জানাবেন এবং নগর বিষয়ে উনি যে পরিকল্পনারগুলোর কথা তার ইশতেহারে বলেছেন সেগুলো নিয়ে তাবিথের সঙ্গে আলোচনা করবেন। এসময় তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান তোফায়েল আহমেদ এবং সভাপতিমণ্ডলীর অপর সদস্য শেখ সেলিমসহ দলীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
এরআগে, ভোট শেষ হওয়ার পরপরই বিকালে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ভোটকেন্দ্রে দলীয় নেতা-কর্মীদের বাধা প্রদান ও ভোটে অনিয়মের বিস্তারিত অভিযোগ তুলে ধরেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ এসময় উপস্থিত ছিলেন। এসময় মির্জা ফখরুল অভিযোগ করেন, ভোট নিয়ে সকালে প্রধানমন্ত্রী যে বক্তব্য দিয়েছেন তা নির্বাচনে হস্তক্ষেপের শামিল বলে মনে করছে বিএনপি। তবে এর জবাবে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সিটি নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে। এবার ইভিএমে ভোট হওয়ায় ভোটারদের আগ্রহ বেশি ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়াও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ১০০ বছরের ইতিহাসে এমন সুষ্ঠু নির্বাচন আর হয়নি।
এদিকে, আনুষ্ঠানিক ফল ঘোষণার আগেই নিজস্ব এজেন্টদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জয়ের খবর নিশ্চিত হয়ে দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে রাতেই দেখা করতে যান আতিক ও তাপস। সেখানে প্রধানমন্ত্রী তাদের অভিনন্দন জানান।
এরআগে, আজ ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটিতে বিরতিহীনভাবে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে টানা একমাস নগরজুড়ে প্রচারণা চালায় সবগুলো দল।
উল্লেখ্য, রাজধানীর বিপুল সংখ্যক নাগরিকের সেবা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে ঢাকা সিটি করপোরেশনকে দু’ভাগে বিভক্ত করে আওয়ামী লীগ সরকার। এরপর ২০১৫ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়। দুটোতেই জয় পায় আওয়ামী লীগ। উত্তর সিটি করপোরেশনে জয়ী হন আনিসুল হক এবং দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সাঈদ খোকন। তবে আনিসুল হক ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর মারা গেলে ডিএনসিসিতে উপনির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হলেও ঢাকার সম্প্রসারিত অংশের সীমানা জটিলতাজনিত কারণে আদালতে রিট হয়। আদালত নির্বাচন আয়োজনের ওপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দিলেও পরবর্তীতে জাতীয় নির্বাচন থাকায় নির্বাচন কমিশন উপনির্বাচনের আয়োজন করে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। ওই উপনির্বাচনে জয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী ও ব্যবসায়ী নেতা মো. আতিকুল ইসলাম। মেয়াদ শেষে নতুন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হলে তাকেই আবার দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করে আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত মেয়র হিসেবে পূর্ণ মেয়াদ পার করলেও শেষ বছরে এসে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবসহ কিছু কারণে বিতর্কিত হয়ে পড়েন সাঈদ খোকন। ঢাকার সাবেক মেয়র মোহাম্মদ হানিফের ছেলে হিসেবে প্রথমবার দলের মনোনয়ন পেলেও এবার আর দলের আনুকূল্য পাননি তিনি। তার বদলে ঢাকা দক্ষিণে মনোনয়ন পান শেখ পরিবারের আরেক সন্তান ও ঢাকা-১০ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। মনোনয়ন চূড়ান্ত হওয়ার পর সংসদ সদস্য পদ ছেড়ে তিনি মেয়র পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হলেন। ফলে প্রার্থী বদল হলেও ঢাকার দুটি মেয়র পদেই ২০১৫ সালের ধারাবাহিকতা ধরে রাখলো আওয়ামী লীগ।
বিজয়ীদের মধ্যে আতিকুল ইসলাম ব্যবসায়ী নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। অন্যদিকে ফজলে নূর তাপস ব্যারিস্টার হিসেবে সুপরিচিত এবং শেখ পরিবারের সন্তান। ১৯৭৫ সালে বঙ্বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার কালরাতে ফজলে নূর তাপসের বাবা শেখ ফজলুল হক মণি এবং মাকেও নৃশংসভাবে হত্যা করে বিপথগামী সেনা সদস্যরা। তখন তার বয়স ছিল মাত্র আড়াই বছর।সূত্র- বাংলাট্রিবিউন।