সাজ্জাদ হোসেন:
দেশে প্রথমবারের মতো গর্ভবতীদের নিয়ে জরিপ করছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। নারীর গর্ভধারণ, মাতৃমৃত্যু, ভ্রূণহত্যাসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসবে এ জরিপে। ২০২২ সাল থেকে চলা এ জরিপের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট চলতি মাসের শেষ দিকে প্রকাশ করবে সংস্থাটি।
বিবিএস-এর চলমান ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২১’ প্রকল্পের আওতায় এ তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের মৃত্যুর সঠিক হিসাব বের করার জন্যই মূলত এ জরিপ করছে সরকার।
প্রতি বছর কত সংখ্যক নারী গর্ভবতী হন এবং কত সংখ্যক ভ্রূণহত্যা করা হচ্ছে তার তথ্যও বের করা হবে। মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায় নবজাতক ২৮ দিনের আগেই মৃত্যুবরণ করছে কি না সেটাও উঠে আসবে এ জরিপে।
বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স ২০২১ প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা তো প্রজননের নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরছি চলমান প্রকল্পের আওতায়। আমরা গর্ভবতী নারীদের তথ্য সংগ্রহ করছি। সন্তানধারণের দিন-তারিখ কবে থেকে শুরু হয়েছে, গর্ভের বাচ্চা কন্যা না ছেলে ইত্যাদি। সন্তান প্রসবের পরও আমরা তথ্য সংগ্রহ করবো।
তিনি আরও বলেন, কেউ যদি বিবাহবহির্ভূতভাবে মা হন সেই তথ্যও সংগ্রহ করছি। এমন কেস আমরা পাচ্ছি না তা বলা যাবে না। প্রায় ছয়টি মায়ের তথ্য পেয়েছি যারা এখনো বিয়ে করেননি। কেউ যদি ভ্রূণহত্যা করে সেই তথ্যও প্রকাশ করা হবে।
বিবিএস জানায়, গর্ভবতী মায়েদের কোন মাসে সবশেষ পিরিয়ড হয়েছে, প্রেগনেন্সির লক্ষণ কবে দেখা দেয়- এসব তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বিবাহিত নারী ছাড়াও বিবাহবহির্ভূতভাবে কোনো নারী গর্ভবতী হয়েছে কি না এসব তথ্য সংগ্রহ করছে বিবিএস। গর্ভধারণের পর অধিকাংশ নারীর মুখের স্বাদ পাল্টে যায়। আবার পছন্দের খাবারও অনেক গর্ভবতী নারীদের মুখে রোচে না। এখানেই শেষ নয়, গর্ভধারণকালে দিন বা রাতের যে কোনো সময় যে কোনো খাদ্য খাবার ইচ্ছা জাগতে পারে। এসব বিষয়েও তথ্য সংগ্রহ করা হবে।
কম বয়সে গর্ভধারণের হার বেশি রংপুরে, বেশি বয়সে সিলেটেঃ
বিবিএসের সবশেষ জরিপে দেখা যায়, নারীদের মধ্যে কম বয়সে সন্তানধারণের প্রবণতা রয়েছে। বয়সভিত্তিক প্রজনন হারের ক্ষেত্রে এমন ধারা দীর্ঘদিন। শহর-গ্রাম নির্বিশেষে ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের মধ্যে প্রজনন হার ধারাবাহিকভাবে বেশি।
সামগ্রিক জন্মহারের বৈশিষ্ট্যগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বয়সের বিন্যাসভিত্তিক জন্মহারের এ পরিস্থিতি সামগ্রিকভাবে সব ক্ষেত্রে একই রকম। কম বয়সে গর্ভধারণের হার রংপুর বিভাগে সবচেয়ে বেশি। এ বিভাগের ২০ বছরের কম বয়সী প্রসূতির গর্ভে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুর জন্ম হয়। এর পরের অবস্থানে আছে রাজশাহী বিভাগ। এ বিভাগে প্রায় ২২ দশমিক ০৮ শতাংশ প্রসূতি ২০ বছরের কম বয়সী। ২০ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগে নারীদের মা হওয়ার অনুপাত সবচেয়ে কম সিলেট বিভাগে। এ বিভাগের ৮ দশমিক ৯ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় ২০ বছরের কম বয়সী মায়ের গর্ভে।
বয়স্ক নারীদের মধ্যে জন্মহার সর্বোচ্চ বেশি সিলেট বিভাগে। এ বিভাগে সবচেয়ে বয়স্ক নারীরা ১ দশমিক ৭৩ শতাংশ শিশুর জন্ম দেন। এ ক্যাটাগরিতে পরের অবস্থানে ময়মনসিংহ বিভাগ। বিভাগটিতে বয়স্ক নারীরা ১ দশমিক ৬২ শতাংশ শিশুর জন্ম দেন। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন অবস্থান খুলনা বিভাগের। এ বিভাগে বয়স্ক নারীরা মাত্র ০ দশমিক ২৫ শতাংশ শিশুর জন্ম দেন।
২০ বছর বয়সের আগেই মা হচ্ছেন ১৯ শতাংশ নারীঃ
বিবিএস জানায়, ২০ বছর বয়সে পৌঁছানোর আগে গড়ে ১৯ শতাংশ নারী সন্তানের মা হন। ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ নারী ২০ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে সন্তানধারণ করেন এবং ২১ দশমিক ২ শতাংশ ত্রিশের পর সন্তানধারণ করেন। গ্রাম ও শহর উভয় ক্ষেত্রে এ অনুপাতটির উপস্থিতি প্রায় একই রকম। গ্রাম এলাকার নারীরা শহর এলাকার নারীদের তুলনায় সব বয়সেই উচ্চ প্রজননক্ষমের অধিকারী।
প্রকল্প পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, যদি কেউ কন্যাসন্তান কোনো কারণে নষ্ট করে ফেলে সেই তথ্যও সংগ্রহ করবো। সেই মায়ের তথ্য-উপাত্তও সংগ্রহ করা হবে। রিপোর্ট তৈরির কাজ চলমান। আশা করি চলতি মাসেই এ ধরনের তথ্য প্রকাশ করতে পারবো। আমরা প্রথমবার এ তথ্য সংগ্রহ করছি।
১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী নারীদের গর্ভধারণের হার বেশিঃ
বিবিএস জরিপে দেখা যায়, ১৫ থেকে ৪৯ বয়সী মায়েদের গর্ভধারণের হার সবচেয়ে বেশি। একজন নারীর বয়স ১৫ বছর হওয়ার আগে বা ৫০ বছর বয়সের পর সন্তান জন্মদানের ঘটনা খুবই বিরল।
কৈশোরে সন্তান জন্মদানঃ
বিবিএস সবশেষ জরিপের তথ্যে দেখা যায়, কিশোরীদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী গ্রুপে মা হওয়ার অনুপাত সবচেয়ে বেশি। প্রতি এক হাজার কিশোরীর বিপরীতে মা হওয়া হার ৭২ দশমিক ৩ জন। মোট ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশুর জন্মের ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ সংঘটিত হয় এ বয়সভিত্তিক গোষ্ঠীর নারীদের মধ্যে।
১৫ বছরের কম বয়সী কিশোরীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মা হন। এ বয়সী গ্রুপের মধ্যে মা হওয়ার হার প্রতি এক হাজারের বিপরীতে ০ দশমিক ২। কিশোরী বয়স অতিক্রান্ত হওয়ার (২০ বছর বা তদূর্ধ্ব) পরের বয়সভিত্তিক নারীদের মধ্যে কিশোরীদের তুলনায় সন্তান প্রসবের হার তুলনামূলক কম। প্রতি এক হাজার জন নারীর বিপরীতে এ শ্রেণির প্রজনন হার ৪৭ দশমিক ৪। সামগ্রিকভাবে ১৯ শতাংশ শিশু জন্মের অবদান রয়েছে কিশোরী মায়েদের।
মৃত অবস্থায় জন্মঃ
বিবিএস জরিপে সামগ্রিক মৃত প্রজনন হার রেকর্ড করা হয়েছে প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মের বিপরীতে ৮ দশমিক ৪ জন। ২০২০ সালের তুলনায় এ হার হ্রাস পেয়েছে প্রায় ২৪ শতাংশ। মৃত শিশুর জন্ম সবচেয়ে বেশি সংঘটিত হয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এ বিভাগে প্রতি এক হাজার জীবিত জন্মের বিপরীতে মৃত অবস্থায় জন্ম হয় ১১ জন শিশুর। এক্ষেত্রে পরের অবস্থানে বরিশাল বিভাগ, ১০ দশমিক ৬। খুলনা বিভাগে মৃত জন্মের হার সবচেয়ে কম, প্রতি ৩ দশমিক ৭। গ্রামাঞ্চলে নারীদের মধ্যে মৃত সন্তান প্রসবের হার শহরের তুলনায় প্রায় ২৫ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি।