ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিট ( সিসিইউ) থেকে ফায়জুল ইসলাম (২৬) নামে এক মুমূর্ষু রোগীকে ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে (আইসিইউ) রেফার করা হয়। কিন্তু অনেক চেষ্টার পরও ওই রোগীকে আইসিইউতে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আইসিইউতে দায়িত্বরত চিকিৎসক রোগীকে দেখতে পর্যন্ত আসেননি। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতের ওই ঘটনার পর ২১ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টা ৪১ মিনিটে রোগী মারা যান। রোগীর মৃত্যুর জন্য আইসিইউ এর ওই চিকিৎসকের অবহেলাকে দায়ী করে পরিবার।
ফায়জুলের ভাই ঝিলু মিয়া বলেন, ‘শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত ভাইকে দুসপ্তাহ আগে গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢামেকে ভর্তি করি। সেখানে তাকে সিসিইউতে রাখা হয়। এরপর রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হলে আইসিইউতে রেফার করেন চিকিৎসকরা। কিন্তু আইসিইউ এর দারোয়ান ( কর্তব্যরত আনসার) আমাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন। গেট থেকে ফেরত দেন। পরদিন ভাই মারা যায়। ভাইকে আইসিইউতে নিতে পারলে হয়তো মরতো না। ভাইয়ের মৃত্যুর জন্য আমরা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালকেই দায়ী করবো। আমি এর বিচার চাই।’
ঝিলু মিয়া আরও বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে জয়ন্ত মালাকার নামে একজন চিকিৎসক আইসিইউতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক তার সঙ্গেও খারাপ আচারণ করেন। যে চিকিৎসক আরেক চিকিৎসকের সঙ্গে এমন আচরণ করতে পারেন, তিনি রোগীদের সঙ্গে কেমন করে কথা বলবেন? উনিতো ডাক্তারই হতে পারবেন না।’
যোগাযোগ করা হলে ঢামেক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন চিকিৎসক জানান, গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সিসিইউ এর কার্ডিওলজি বিভাগের ইউনিট-৪ এর সহকারী রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন চিকিৎসক জয়ন্ত মালাকার। সেখানে চিকিৎসাধীন এক রোগীকে জরুরিভিত্তিতে আইসিইউতে নেওয়ার দরকার হয়। রোগীর বাবাকে সঙ্গে নিয়ে চিকিৎসক জয়ন্ত মালাকার আইসিইউতে যান। সিসিইউ এর একজন নার্সও যান। কিন্তু এ সময় সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক রাজনৈতিক পরিচয় দিয়ে জয়ন্ত মালাকারকে বলেন, ‘আমার আইসিইউতে এসে উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস হয় কীভাবে?’
চিকিৎসকরা আরও বলেন, একজন রাজনীতিবিদ হলে তার বোঝা উচিত ছিল, রোগীর অবস্থা কী পরিমাণ খারাপ হলে একজন সহকারী রেজিস্ট্রার নিজে ছুটে আসেন। হাসপাতালের স্বার্থেই এসব রোগী দ্রুত দেখে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। আইসিইউ তো কারও নিজের না, সেটা সরকারি এবং তা রোগীর জন্য। কী করে মানবতাবর্জিত পলিটিক্যাল চিকিৎসক এ রকম গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করতে পারেন? তিনি যা করেছেন তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজনৈতিক পরিচয় দেওয়া ওই চিকিৎসকের নাম মো. আব্বাস উদ্দীন আহমেদ। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পোস্টেড চিকিৎসক নন, ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিনের এমডি কোর্সের ছাত্র।
যোগাযোগ করা হলে ডা. জয়ন্ত মালাকার বাংলা ট্রিবিউনকে পুরো ঘটনার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, ‘রাত ১০টার পর সিসিইউতে এক রোগীর খিঁচুনি শুরু হয়, তার আগেও এ রকম হয়েছে। এরপর তাকে চিকিৎসা দিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনার পর ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে আইসিইউতে নেওয়ার জন্য রেফারাল লেটার দেওয়া হয়। কিন্তু সেখানে যোগাযোগ করেও কোনও লাভ হয়নি। এরপর রাত ১১টার দিকে আবার খিঁচুনি শুরু হয়, ছিল শ্বাসকষ্টের সমস্যাও।’
জয়ন্ত মালাকর আরও বলেন, “আইসিইউতে যোগাযোগ করা সম্ভব না হওয়াতে রোগীর স্বজনদের বলা হয় আইসিউতে কর্তব্যরত কনসালট্যান্টের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু রাত ১২টার দিকে রোগীর ভাই আইসিইউ থেকে এসে বলেন, এক ঘণ্টা চেষ্টা করেও আইসিইউর চিকিৎসকদের সঙ্গে তিনি দেখা করতে পারেননি। আইসিইউ এর গেটে কর্তব্যরত আনসার তাকে বলেছেন, রাত ১২টার পর রেফারাল নিয়ে এলেও আইসিউতে কাউকেই প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। আমি তাকে আবারও যেতে বলি, কিন্তু ‘স্যারের নিষেধ’ আছে বলে দারোয়ান এবারও গেট থেকে তাকে পাঠিয়ে দেন।”
এরপর ডা. জয়ন্ত নিজে যান আইসিইউতে। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি ভেতরে থাকা চিকিৎসকের কাছে যান। রাত ১২টার পর হলেও জরুরি রেফার করা রোগীকে কেন আইসিইউতে নেওয়া যাবে না জানতে চাইলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, এটাই তাদের নিয়ম।
আইসিইউ এর চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর পরিবার দেখা করতে পারবেন না—এটা করা ঠিক নয়, ডা. জয়ন্তের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ওই চিকিৎসক তাকে গলার স্বর নামিয়ে কথা বলতে বলেন। এও বলেন, ‘আমার আইসিইউতে এসে আমার ওপর উচ্চস্বরে কথা বলার সাহস কীভাবে?’
রোগীর পরিবার এতটাই দরিদ্র যে, তার চিকিৎসা হচ্ছিল হাসপাতালের দরিদ্র তহবিল থেকে সাহায্য নিয়ে।–জানান ডা. জয়ন্ত
জানতে চাইলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এ কে এম নাসির উদ্দীন বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘এটা নিয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাই না।’
এদিকে, ডা. আব্বাস উদ্দীন আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।