মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে নাশকতাকারীরা নজরদারিতে

প্রকাশিত: ৭:২৫ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ২১, ২০২৩

এসএম দেলোয়ার হোসেন:
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগানোর ঘটনায় জড়িত নাশকতাকারীরা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। তবে কয়েকটি রেলস্টেশন ও আশপাশের এলাকা থেকে সংগ্রহ করা সিসিটিভির ফুটেজ ও ট্রেনে ভ্রমণ করা কয়েকজন যাত্রীর সঙ্গে কথা বলে প্রাপ্ত তথ্য নিয়ে চুলচেড়া বিশ্লেষণ করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছে, ট্রেনে পোড়া জিনিসের নমুনায় ফসফরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। আগুন দেওয়ার সময় রাসায়নিক ব্যবহার করা হতে পারে। এর সঙ্গে পেট্রোল দিয়েও আগুন লাগানো হতে পারে। প্রাথমিকভাবে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে তিনজন ব্যক্তিকে সন্দেহ করা হচ্ছে। যারা বিমানবন্দর থেকে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে ওঠেন। এই তিনজনের পরিচয় জানার চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে হাতব্যাগ নিয়ে ট্রেনে ওঠা সন্দেহভাজন একব্যক্তিকে খুঁজছে পুলিশ। জড়িতরা ইতোমধ্যেই চিহ্নিত হয়েছে তাদের নাম-পরিচয়ও পাওয়া গেছে। তবে তারা যে কোনো মুহুর্তে গ্রেফতার হতে পারেন। তাদের চলাফেরা ও গতিবিধি নজরদারি করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ডিবি প্রধান ও র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক। আজ বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) রেলওয়ে পুলিশ, ডিবি ও র‌্যাবের তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।


খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সোমবার (১৮ ডিসেম্বর) দিবাগত রাত সোয়া ১১টার দিকে নেত্রকোনা থেকে যাত্রী নিয়ে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা করে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন। ট্রেনটি রাত পেরিয়ে পরদিন মঙ্গলবার (১৯ ডিসেম্বর) ভোর ৫টার কিছুক্ষণ আগে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশনে যাত্রাবিরতি করে। ৩ মিনিটের যাত্রাবিরতি শেষে সেখান থেকে ট্রেনটি ছেড়ে আসার সময় ক্যান্টনমেন্ট রেলস্টেশন অতিক্রম করে সৈনিক ক্লাবে পৌঁছামাত্র ট্রেনের যাত্রীরা দুটি বগির মাঝে আগুন দেখতে পায়। তখন আতঙ্কিত যাত্রীরা আগুন আগুন বলে ডাক-চিৎকার শুরু করেন। অনেকেই প্রাণভয়ে নামার জন্য ট্রেনের বগির মধ্যে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে থাকেন। অনেকেই ট্রেন থামাতে রেলের স্টাফদের ডাকতে থাকেন। কিন্তু ট্রেন চালক যাত্রীদের আর্তচিৎকার শুনতে না পারায় চলন্ত ট্রেনের একে একে ৩টি বগিতে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে থাকে। ভোর ৫টা ৫ মিনিটের দিকে ট্রেনে আগুন লাগানোর বিষয়টি বুঝতে পেরে তেজগাঁও রেলস্টেশনের অদুরেই তামিয়ে দেন। ততক্ষণে একটি বগিতে আটকে পড়া মা নাদিয়া আক্তার পপি ও তার ৩ বছরের কোলের শিশুপুত্র ইয়াসিন, খোকন মিয়া ও রশিদ ঢালী নামের ৪ জন আগুনে পুড়ে প্রাণ হারান। একই সঙ্গে লাফিয়ে পড়ে নুরুল হকসহ আহত হয়েছেন আরও বেশকিছু যাত্রী। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ৩টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে সকাল পৌনে ৭টার দিকে আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। ঘটনার পরপরই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ পুলিশ, র‌্যাব, সিআইডি, সিটিটিসি, পিবিআই ও ডিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা। এ সময় সংস্থাগুলো যার যার মত করে ঘটনাস্থল থেকে বেশকিছু নমুনা সংগ্রহ করে রাসায়নিক পরীক্ষাগারে পাঠায় এবং ছায়া তদন্ত শুরু করে।
ডিএমপির তদন্ত সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে নাশকতার ঘটনাটি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ঘটনার রহস্য উদঘাটনে এবং জড়িতদের চিহ্নিত করতে রেলের গার্ড, স্টুয়ার্ড, চালক ও গেটকিপারদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শুনছে।


এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) তার নিজ কার্যালয়ে ডিএমপির ডিবি প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, তেজগাঁওয়ে ট্রেনে নাশকতার এ ঘটনায় ছায়াতদন্ত করছে ডিবি পুলিশ। মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনায় জড়িতদের নাম পাওয়া গেছে। তাদের শিগগিরই আইনের আওতায় আনার জন্য কাজ করছে ডিবি পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (অপারেশনস) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, সর্বোচ্চ কোনো মহলের নির্দেশনায় ট্রেনে নাশকতার এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। সেটি দেশের ভেতরে বা দেশের বাইরে থেকে অন্য কেউ ইঙ্গিত দিতেও পারে। অতীতে যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের ব্যাপারেও দৃষ্টি রয়েছে। তারা সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিচ্ছে। গাজীপুরে ট্রেনের লাইন কেটে রেখেছে। এসব ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন ভাবার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে যে পার পাওয়া যাবে না, ডিএমপি সেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায়। সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। জড়িতরা যত হাই লেভেলের বা লো প্রোফাইলের হোক না কেন, আমরা কাউকেই ছাড়বো না।


এদিকে আজ বৃহস্পতিবার (২১ ডিসেম্বর) কমলাপুর রেলস্টেশনে এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ এর অধিনায়ক কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন লাগার ঘটনায় চারজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। এরমধ্যে দুজন বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী, বাকি দুজন ভাসমান ব্যক্তি। তাদের চলাফেরা ও গতিবিধি নজরদারি করা হচ্ছে। তবে এ মুহুর্তে তদন্তের স্বার্থে আমরা কারও নাম প্রকাশ করছি না।


জানা যায়, দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের ৩টি বগি পুড়ে গেছে। বগিগুলো হচ্ছে- ‘ছ’, ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগি। বিমানবন্দর স্টেশনে ট্রেনটি থামার পর ১৪টি বগির মধ্যে পুড়ে যাওয়া তিন বগির একটিতে যাত্রী ওঠানামা করেছে। সেটি ‘ছ’ বগি। তিন মিনিটের বিরতিতে ওই ‘ছ’ বগিতে কয়েকজন ওঠানামা করেন। পুলিশের সন্দেহ, যাত্রীবেশে ‘ছ’ বগিতে নাশকতাকারীরা উঠেছিল। এরপর সুযোগ বুঝে ‘জ’ ও ‘ঝ’ বগির মাঝে আগুন দেয়।
পুলিশের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, বিমানবন্দর স্টেশন থেকে ওই ট্রেনে বেশ কয়েকজনের যাত্রী উঠেছেন। ফুটেজে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে কেউ উঠেছেন কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি নাশকতাকারীরা বিমানবন্দরের আগের স্টেশনগুলোর মধ্যে কোনো একটি থেকে উঠেছেন কি না তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
ডিএমপির সিটিটিসির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, আগুনের ঘটনায় আহত কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন জানিয়েছেন আগুন লাগার আগে ট্রেনের দরজা খুলে দুজন যুবক কথা বলছিলেন। এক পর্যায়ে একজন যাত্রী তাদের জিজ্ঞেস করেন, এই ঠান্ডার মধ্যে দরজা খোলা রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন?। জবাবে তাদের একজন ওই যাত্রীকে জানান, তারা দরজা বন্ধ করে তাদের সিটে কিছু সময়ের মধ্যে বসবেন। এছাড়া ওই দুই যুবক কোথা থেকে ট্রেনে উঠেছিলেন তা জানার চেষ্টা চলছে।
সিটিটিসি জানায়, পোড়া জিনিসের নমুনায় ফসফরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তবে রাসায়নিক প্রতিবেদন পাওয়ার পর সঠিকভাবে বলা যাবে আগুনে কী ব্যবহার করা হয়েছিল।
এদিকে ডিএমপির গোয়েন্দা সংশ্লিষ্টরা জানায়, দুর্ঘটনাস্থলের কাছাকাছি বিভিন্ন স্টেশন এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে এক যুবকের আচরণ সন্দেহজনক মনে হয়েছে। তার হাতে ব্যাগ ছিল। তাকে খোঁজা হচ্ছে। এ ঘটনায় মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেসের পরিচালক মো. খালেদ মোশারেফ বাদী হয়ে ঘটনার দিন রাতে ঢাকা রেলওয়ে থানায় মামলা করেছেন। রেলওয়ে পুলিশ মামলাটির তদন্ত করলেও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) তদন্ত আগ্রহ জানিয়েছে।


ঢাকা রেলওয়ে থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস জানান, মামলায় ট্রেনে নাশকতা চালিয়ে যাত্রী হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো কাউকে গ্রেফতার বা আটক করা হয়নি। রেলওয়ে পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থার সদস্যরা দুর্বৃত্তদের শনাক্ত ও গ্রেফতারে কাজ করছে।


রেলপথ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৮ অক্টোবরের পর থেকে হরতাল-অবরোধের মধ্যে এ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চারটি ট্রেনে আগুন দেওয়া এবং রেললাইন কেটে ফেলার একটি ঘটনা ঘটিয়েছে দুর্বৃত্তরা। আর, সর্বশেষ গত মঙ্গলবার চারজনসহ মারা গেছেন পাঁচজন। রেললাইনে আরও ১৯টি অগ্নিসংযোগ এবং ৮টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।